পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ܕܛܛ . . . ܗfR* রাজার আশ্রয়ে এক-এক জন সাহিত্যকরি আপনি কীর্তি স্বতন্ত্ৰ ভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়া গিয়াছেন। কালিদাস কেবল বিক্ৰমাদিত্যের, চাঁদবর্দি কেবল পৃথীরাজের, চাণক্য কেবল চন্দ্রগুপ্তের। তাহারা । তৎকালীন সমস্ত ভারতবর্ষের নহেন, এমনকি তৎপ্রদেশেও তীহাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কোনাে । যোগ খুজিয়া পাওয়া যায় না। - সম্মিলিত জাতীয় হৃদয়ের মধ্যে যখন সাহিত্য আপন উত্তপ্ত সুরক্ষিত নীড়টি বাধিয়া বসে তখনই সে আপনার বংশ রক্ষা করিতে, ধারাবাহিক ভাবে আপনাকে বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত করিয়া দিতে পারে। সেইজন্য প্রথমেই বলিয়াছি সহিতত্বই সাহিত্যের প্রধান উপাদান ; সে বিচ্ছিন্নকে এক করে, এবং যেখানে ঐক্য সেইখানে আপন প্রতিষ্ঠভূমি স্থাপন করে। যেখানে একের সহিত অন্যের, কালের । সহিত কালান্তরের, গ্রামের সহিত ভিন্ন গ্রামের বিচ্ছেদ, সেখানে ব্যাপক সাহিত্য জন্মিতে পারে না। আমাদের দেশে কিসে অনেক লোক এক হয় ? ধর্মে। সেইজন্য আমাদের দেশে কেবল ধর্মসাহিত্যই আছে। সেইজন্য প্রাচীন বঙ্গসাহিত্য কেবল শাক্ত এবং বৈষ্ণব কাব্যেরই সমষ্টি । রাজপূতগণকে বীরগীেরবে এক করিত, এইজন্য বীরগীেরব তাঁহাদের কবিদের গানের বিষয় ছিল। আমাদের ক্ষুদ্র বঙ্গদেশেও একটা সাধারণ সাহিত্যের হাওয়া উঠিয়াছে। ধর্মপ্রচার হইতেই ইহার আরম্ভ। প্রথমে র্যাহারা ইংরাজি শিখিতেন তাহারা প্রধানত আমাদের বণিক ইংরাজ-রাজের নিকট উন্নতিলাভের প্রত্যাশাতেই এ কার্যে প্রবৃত্ত হইতেন ; তঁহাদের অর্থকরী বিদ্যা সাধারণের কোনো কাজে লাগিতা না। তখন সর্বসাধারণকে এক শিক্ষায় গঠিত করিবার সংকল্প কাহারও মাথায় উঠে নাই ; তখন কৃতী-পুরুষগণ যে যাহার আপনি আপন পন্থা দেখিত। - বাংলার সর্বসাধারণকে আপনাদের কথা শুনাইবার অভাব খৃস্টীয় মিশনারিগণ সর্বপ্রথমে অনুভব করেন, এইজন্য তাহারা সর্বসাধারণের ভাষাকে শিক্ষাবহনের ও জ্ঞানবিতরণের যোগ্য করিয়া তুলিতে প্রবৃত্ত হইলেন। কিন্তু এ কার্য বিদেশীয়ের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে সম্ভবপর নহে। নব্যবঙ্গের প্রথম সৃষ্টিকর্তা রাজা রামমােহন রায়ই প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে গদ্যসাহিত্যের ভূমিপত্তন করিয়া দেন। ইতিপূর্বে আমাদের সাহিত্য কেবল পদ্যেই বদ্ধ ছিল। কিন্তু রামমোহন রায়ের উদ্দেশ্যসাধনের পক্ষে পদ্য যথেষ্ট ছিল না। কেবল ভাবের ভাষা, সৌন্দর্যের ভাষা, রসজ্ঞের ভাষা নহে ; যুক্তির ভাষা, বিবৃতির ভাষা, সর্ববিষয়ের এবং সর্বসাধারণের ভাষা তঁহার আবশ্যক ছিল। পূর্বে কেবল ভাবুকসভার জন্য পদ্য ছিল, এখন জনসভার জন্য গদ্য অবতীর্ণ হইল। এই গদ্যপদ্যর সহযোগ -ব্যতীত কখনো কোনো সাহিত্য সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হইতে পারে না। খাস-দরবার এবং আম-দরবার ব্যতীত সাহিত্যের রাজ-দরবার সরস্বতী মহারানীর সমস্ত প্রজাসাধারণের উপযোগী হয় না। রামমোহন রায় আসিয়া । সরস্বতীর সেই আম-দরবারের সিংহদ্বার স্বহস্তে উদঘাটিত করিয়া দিলেন । । আমরা আশৈশবকাল গদ্য বলিয়া আসিতেছি, কিন্তু গদ্য যে কী দুরূহ ব্যাপার তাহা আমাদের প্রথম গদ্যকারীদের রচনা দেখিলেই বুঝা যায়। পদ্যে প্রত্যেক ছত্রের প্রান্তে একটি করিয়া বিশ্রামের স্থান আছে, প্রত্যেক দুই ছত্র বা চারি ছত্রের পর একটা করিয়া নিয়মিত ভাবের ছেদ পাওয়া যায় ; কিন্তু । গদ্যে একটা পদের সহিত আর-একটা পদকে বাধিয়া দিতে হয়, মাঝে ফাক রাখিবার জো নাই ; পদের মধ্যে কর্তা কর্ম ক্রিয়াকে এবং পদগুলিকে পরস্পরের সহিত এমন করিয়া সাজাইতে হয় যাহাতে গদ্যপ্রবন্ধের আদ্যন্তমধ্যে যুক্তিসম্বন্ধের নিবিড় যোগ ঘনিষ্ঠরূপে প্রতীয়মান হয়। ছন্দের একটা অনিবাৰ্য প্রবাহ আছে ; সেই প্রবাহের মাঝখানে একবার ফেলিয়া দিতে পারিলে কবিতা সহজে নাচিতে নাচিতে ভাসিয়া চলিয়া যায় ; কিন্তু গদ্যে নিজে পথ দেখিয়া পায়ে হঁটিয়া নিজের ভারসামঞ্জস্য করিয়া চলিতে হয়, সেই পদব্ৰজ-বিদ্যাটি রীতিমত অভ্যাস না থাকিলে চাল অত্যন্ত আঁকাবঁকা এলোমেলো এবং টলমলে হইয়া থাকে। গদ্যের সুপ্ৰণালীবদ্ধ নিয়মটি আজকাল আমাদের অভ্যস্ত হইয়া গেছে, কিন্তু অনধিককাল পূর্বে এরূপ ছিল না। তখন যে গদ্য রচনা করাই কঠিন ছিল তাহা নহে, তখন লোকে অনভ্যাসবশত গদ্য প্ৰবন্ধ সহজে