পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

आश्छि । ዩeዓፄ মধ্যে সমাজ যে স্থিরভাবে ছিল, তাহা সম্ভব নহে। তখনকার সেই আধ্যাত্মিক অরাজকতার মধ্যে বাংলাদেশে যেন একটা দেবদেবীর লড়াই বাধিয়াছিল; তখন সমস্ত সাজ-সরঞ্জাম সমেত এক দেবতার মন্দির আর-এক দেবতা অধিকার করিয়া পূজাৰ্চনায় নানাপ্রকার মিশ্রণ উৎপন্ন করিতেছিল। তখন এক দেবতার বিগ্রহে আর-এক দেবতার সঞ্চার, এক সম্প্রদায়ের তীর্থে আর-এক সম্প্রদায়ের প্রাদুর্ভাব, এমনি একটা বিপর্যয়ব্যাপার ঘটিতেছিল। ঠিক সেই সময়কার কথা সাহিত্যে আমরা স্পষ্ট করিয়া ইহা দেখিতেছি, বৈদিক কালের দেবতন্ত্রে মহাদেবের আধিপত্য নাই। তাহার পরে দীর্ঘকালের ইতিহাসহীন নিস্তব্ধতা কাটিয়া গেলে দেখিতে পাই,ইন্দ্র ও বরুণ ছায়ার মতো অস্পষ্ট হইয়া গেছে এবং ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে দ্বন্দ্ব ও মিলন ঘটিতেছে। এই দৈবসংগ্রামে ব্ৰহ্মা সর্বপ্রথমেই পূজাগৃহ হইতে দূরে আশ্রয় লইলেন, বিষ্ণু নানা পরিবর্তনের মধ্যে নানা আকারে নিজের দাবি রক্ষা করিতে লাগিলেন, এবং মহেশ্বর এক সময়ে অধিকাংশ ভারত অধিকার করিয়া লইলেন। এই সকল দেবীদ্বন্দ্বের মূল কোথায় তাহা অনুসন্ধানযোগ্য। ভারতবর্ষের কটাহে আৰ্য অনার্য নানা জাতির সম্মিশ্রণ হইয়াছিল। এক-এক সময়ে এক-এক জাতি ফুটিয়া উঠিয়া আপন আপন দেবতাকে জয়ী করিয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। অনবরত বিপ্লবের সময় হিন্দুর প্রতিভা সমস্ত বিরোধবিপ্লবের মধ্যে আপনার ঐক্যসূত্র বিস্তার করিয়া নানা বৈপরীত্য ও বৈচিত্র্যের মধ্যে আৰ্য-অনার্যের - সমন্বয়-স্থাপনের চেষ্টা করিতেছিল। কথাসরিৎসাগরে আছে, একদা ব্ৰহ্মা ও বিষ্ণু হিমাদ্রিপাদমূলে কঠোর তপস্যা সহকারে ধূর্জটির আরাধনায় নিযুক্ত হইয়াছিলেন। শিব তুষ্ট হইয়া বর দিতে উদ্যত হইলে, ব্ৰহ্মা শিবকেই নিজের পুত্ররূপে লাভ করিবার প্রার্থনা করিলেন। এই অনুচিত আকাঙক্ষার জন্য তিনি নিন্দিত ও লোকের নিকট অপূজ্য হইলেন। বিষ্ণু এই বর চাহিলেন, যেন আমি তোমারই সেবাপর হইতে পারি। শিব ভূক্ষ্ম সন্থী ইয়া বিষ্ণুক নেিজর অর্থল করিয়া লইলেন। সেই অর্ধাঙ্গই শিবের শক্তিরূপিণী এক-এক সময়ে এক-এক দেবতা বড়ো হইয়া অন্যান্য দেবতাকে কিরূপে গ্ৰাস করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, এই গল্পেই তাহা বুঝা যায়। ব্ৰহ্মা, যিনি চারি বেদের চতুরমুখ বিগ্ৰহম্বরূপ, তিনি বেদবিদ্রোহী বৌদ্ধযুগে অধীকৃত হইয়াছিলেন। বিষ্ণু, যিনি বেদে ব্ৰাহ্মণদের দেবতা ছিলেন, তিনিও একসময়ে হীনবল হইয়া এই শ্মশানচারী কপালমালী দিগম্বরের পশ্চাতে আশ্রয় লইতে বাধ্য হইয়াছিলেন । শিবের যখন প্রথম অভ্যুত্থান হইয়াছিল তখন বৈদিক দেবতারা যে তঁহাকে আপনাদের মধ্যে স্থান দিতে চান নাই তাহা দক্ষযজ্ঞের বিবরণেই বুঝা যায়। বস্তুতই তখনকার অন্যান্য আর্যদেবতার সহিত এই বিলোচনের অত্যন্ত প্রভেদ। দক্ষের মুখে যে-সকল নিন্দ বসানো হইয়াছিল তখনকার আর্যমণ্ডলীর মুখে সে নিন্দা স্বাভাবিক। সমস্ত দেবমণ্ডলীর মধ্যে ভূতপ্রেতপিশাচের দ্বারা এই অদ্ভুত দেবতা-কর্তৃক দক্ষযজ্ঞধ্বংশ কেবল কাল্পনিক কথা নহে। ইহা একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের তুল্য। আর্যমণ্ডলীর যে বৈদিক যজ্ঞে প্রাচীন আর্যদেবতারা আহূত হইতেন সেই যজ্ঞে এই শ্মশানেশ্বরকে দেবতা বলিয়া স্বীকার করা হয় নাই এবং তঁহাকে অনার্য অনাচারী বলিয়া নিন্দ করা হইয়াছিল ; সেই কারণে র্তাহার সেবকদের সহিত আৰ্যাদবপূজকদের প্রচণ্ড বিরোধ বাধিয়াছিল। এই বিরোধে অনার্য ভূত প্ৰেত পিশাচের দ্বারা বৈদিক যজ্ঞ লণ্ডভণ্ড হইয়া যায় এবং সেই শোণিতাক্ত অপবিত্ৰ যজ্ঞবেদীর উপরে নবাগত দেবতার প্রাধান্য বলপূর্বক স্থাপিত হয়। আর্যাদবসমাজে এই অদ্ভুতাচারী দেবতা বলপূর্বক প্রবেশ করিলেন বটে, কিন্তু ইহাকে অনেক জবাবদিহি করিতে হইয়াছিল। কথাসরিৎসাগরেই আছে, একদা পার্বতী শঙ্কুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, নরকপালে এবং শ্মশানে তোমার এমন গ্ৰীতি কেন ? এ প্রশ্ন তখনকার আর্যমণ্ডলীর প্রশ্ন। আমাদের আর্যদেবতারা স্বৰ্গবাসী ; তাহারা বিকৃতিহীন, সুন্দর,