পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ეხr\ტ রবীন্দ্র-রচনাবলী ইতিহাসের শত্ৰু তেমনি অন্য দিকে গল্পেরও মন্ত রিপু। অর্থাৎ উপন্যাসলেখক গল্পের খাতিরে ইতিহাসকে আঘাত করেন, আবার সেই আহত ইতিহাস র্তাহার গল্পকেই নষ্ট করিয়া দেয় ; ইহাতে গল্প-বেচারার শ্বশুরকুল পিতৃকুল দুই কুলই মাটি । এমন বিপদ সত্ত্বেও কেন ঐতিহাসিক কাব্য-উপন্যাস সাহিত্যে স্থান পায় ? আমরা তাহার যে কারণ মনে জানি সেটা ব্যক্তি করিবার চেষ্টা করি । আমাদের অলংকারশাস্ত্রে রসাত্মক বাক্য বলিয়া কাব্যের যে সংজ্ঞা নির্দেশ করা হইয়াছে তাহা অপেক্ষা সংক্ষিপ্ত অথচ ব্যাপক সংজ্ঞা আর কোথাও দেখি নাই। অবশ্য, রস কাহাকে বলে সে আর বুঝাইবার জো নাই। যে-কোনো ব্যক্তির আস্বাদনশক্তি আছে রস শব্দের ব্যাখ্যা তাহার নিকট অনাবশ্যক ; যাহার ঐ শক্তি নাই তাহার এ-সমস্ত কথা জানিবার কোনো প্রয়োজনই নাই । আমাদের অলংকারে নয়টি মূল্যরসের নামোল্লেখ আছে। কিন্তু অনেকগুলি অনির্বচনীয় মিশ্ররস আছে, অলংকারশাস্ত্রে তাহার নামকরণের চেষ্টা হয় নাই । সেই-সমস্ত অনির্দিষ্ট রসের মধ্যে একটিকে ঐতিহাসিক রস নাম দেওয়া যাইতে পারে । এই রাস মহাকাব্যের প্রাণস্বরূপ । ব্যক্তিবিশেষের সুখদুঃখ তাহার নিজের পক্ষে কম নহে, জগতের বড়ো বড়ো ঘটনা তাহার নিকট ছায়ায় পড়িয়া যায়, এইরূপ ব্যক্তিবিশেষের অথবা গুটিকতক জীবনের উত্থানপতন-ঘাতপ্রতিঘাত উপন্যাসে তেমন করিয়া বর্ণিত হইলে রসের তীব্রতা বাডিয়া উঠে ; এই রসাবেশ আমাদিগকে অত্যন্ত নিকটে আসিয়া আক্রমণ করে । আমাদের অধিকাংশেরই সুখদুঃখের পরিধি সীমাবদ্ধ ; আমাদের জীবনের তরঙ্গক্ষোভ কয়েকজন আত্মীয়বন্ধুবান্ধবের মধ্যেই অবসান হয়। বিষবৃক্ষে নগেন্দ্রসূর্যমুখী-কুন্দনন্দিনীর বিপদসম্পদ-হৰ্ষবিষাদ আমরা আপনার করিয়া বুঝিতে পারি ; কারণ, সে-সমস্ত সুখদুঃখের কেন্দ্ৰস্থল নগেন্দ্রের পরিবারামণ্ডলী । নগেন্দ্ৰকে আমাদের নিকট প্রতিবেশী বলিয়া মনে করিতে কিছুই বাধে না । কিন্তু পৃথিবীতে অল্পসংখ্যক লোকের অভু্যদয় হয়। র্যহাদের সুখদুঃখ জগতের বৃহৎব্যাপারের সহিত বদ্ধ। রাজ্যের উত্থানপতন, মহাকালের সুদূর কার্যপরম্পরা যে সমুদ্রগর্জনের সহিত উঠিতেছে পড়িতেছে, সেই মহান কলসংগীতের সুরে তঁহাদের ব্যক্তিগত বিরাগ-অনুরাগ বাজিয়া উঠিতে থাকে । তঁহাদের কাহিনী যখন গীত হইতে থাকে তখন রুদ্রবীণার একটা তারে মূলরাগিণী বাজে এবং বাদকের অবশিষ্ট চার আঙুল পশ্চাতের সরু মোটা সমস্ত তারগুলিতে অবিশ্রাম একটা বিচিত্র গভীর, একটা সুদূরবিস্তৃত ঝংকার জাগ্ৰত করিয়া রাখে। এই-যে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে কালের গতি ইহা আমাদের প্রতিদিনের প্রত্যক্ষগোচর নহে। যদি বা তেমন কোনো জাতীয় ইতিহাসস্রষ্টা মহাপুরুষ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত থাকেন তথাপি কোনো খণ্ড ক্ষুদ্র বর্তমান কালে তিনি এবং সেই বৃহৎ ইতিহাস একসঙ্গে আমাদের দৃষ্টিগোচর হইতে পারে না। অতএব সুযোগ হইলেও এমন-সকল ব্যক্তিকে আমরা কখনাে ঠিকমত তাঁহাদের যথার্থ প্রতিষ্ঠভূমিতে উপযুক্তভাবে দেখিতে পাই না। তঁহাদিগকে কেবল ব্যক্তিবিশেষ বলিয়া নহে, পরন্তু মহাকালের অঙ্গস্বরূপ দেখিতে হইলে, দূরে দাড়াইতে হয়, অতীতের মধ্যে র্তাহাদিগকে স্থাপন করিতে হয়, তাহারা যে সুবৃহৎ রঙ্গভূমিতে নায়কস্বরূপ ছিলেন সেটা-সূদ্ধ তাহাদিগকে এক করিয়া দেখিতে হয় । এই-যে আমাদের প্রতিদিনের সাধারণ সুখদুঃখ হইতে দূরত্ব, আমরা যখন চাকরি করিয়া কঁদিয়া-কাটিয়া খাইয়া-দাইয়া কাল কাটাইতেছি তখন যে জগতের রাজপথ দিয়া বড়ো বড়ো সারথিরা কালরথ চালনা করিয়া লইয়া চলিতেছেন, ইহাই অকস্মাৎ ক্ষণকালের জন্য উপলব্ধি করিয়া ক্ষুদ্র পরিধি হইতে মুক্তিলাভ— ইহাই ইতিহাসের প্রকৃত রসস্বাদ । এরূপ ব্যাপার আগাগোড়া কল্পনা হইতে সৃজন করা যায় না যে তাহা নহে। কিন্তু যাহা স্বভাবতই আমাদের হইতে দূরস্থ, যাহা আমাদের অভিজ্ঞতার বহির্বতী, তাহাকে কোনাে একটা ছুতায় খানিকটা প্রকৃত ঘটনার সহিত বঁধিয়া দিতে পারিলে পাঠকের প্রত্যয়-উৎপাদন লেখকের পক্ষে সহজ হয়।