পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१०७ রবীন্দ্র-রচনাৱলী নানারকম করে বলবার চেষ্টা করছি, প্রত্যেক পুনরুক্তিতে পূর্বের কথা কতকটা সম্মার্জন পরিবর্তন করে চলা যাচ্ছে— তাতে তর্কের লক্ষ্য স্থির রাখা তোমার পক্ষে শক্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু তুমি পূর্ব হতেই জান, খণ্ড খণ্ড ভাবে তর্ক করা আমার কাজ নয় । সমস্ত মোট কথাটা গুছিয়ে না। উঠতে পারলে আমি জোর পাই নে । মাঝে মাঝে সুতীক্ষ সমালোচনায় তুমি যেখানটা ছিন্ন করছ, সেখানকার জীৰ্ণতা সেরে নিয়ে দ্বিতীয়বার আগাগোড়া ফেদে দাড়াতে হচ্ছে ।-- তার উপরে আবার উপমার জ্বালায় তুমি বোধ হয় অস্থির হয়ে উঠেছ। কিন্তু আমার এ প্রাচীন রোগটিও তোমার জানা আছে। মনের কোনো একটা ভােব ব্যক্ত করবার ব্যাকুলত জন্মালে আমার মন সেগুলোকে উপমার প্রতিমাকারে সাজিয়ে পাঠায়, রচনাপ্ৰণালী অত্যন্ত বহুকেলে ; মনের কথাকে সাক্ষাৎভাবে ব্যক্তি না করে প্রতিনিধিদ্বারা ব্যক্তি করা । এরকম করলে যুক্তিসংসারের আদানপ্রদান পরিষ্কাররূপে চালানো অসম্ভব হয়ে ওঠে । যা হােক, আগে তুমি লিখেছি, আমার সঙ্গে এ তর্ক তুমি মোকাবিলায় চােকাতে চাও। তা হলে আমার পক্ষে ভারি মুশকিল। তা হলে কেবল টুকরো নিয়েই তর্ক হয়, মোট কথাটা আজ থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত তোমাকে বোঝাতে পারি। নে ! নিজের অধিকাংশ মতের সঙ্গে নিজের প্রত্যক্ষ পরিচয় থাকে না । তারা যদিচ আমার আচারে ব্যবহারে লেখায় নিজের কাজ নিজে করে যায়, কিন্তু আমি কি সকল সময়ে তাদের করতে পারি নে— নামও জানি নে, চেহারাও চিনি নে । লেখবার একটা সুবিধে এই যে, আপনার মতের সঙ্গে পরিচিত হবার একটা অবসর পাওয়া যায় ; লেখার সঙ্গে সঙ্গে আমনি নিজের মতটাকে যেন স্পর্শদ্বারা অনুভব করে যাওয়া যায়।— নিজের সঙ্গে নূতন পরিচয়ে প্রতি পদে একটা নূতন আনন্দ পাওয়া যায়, এবং সেই উৎসাহে লেখা এগোতে থাকে। সেই নূতন আনন্দের আবেগে লেখা অনেক সময় জীবন্ত ও সরস হয় । কিন্তু তার একটা অসুবিধাও আছে । কঁচা পরিচয়ে পাকা কথা বলা যায় না । তেমন চেপে ধরলে ক্ৰমে কথার একটু-আধটু পরিবর্তন করতে হয় । চিঠিতে আস্তে আস্তে সেই পরিবর্তন করবার সুবিধা আছে। প্রতিবাদীর মুখের সামনে মতিস্থির থাকে না এবং অত্যন্ত জিদ বেড়ে যায় ; অতএব মুখোমুখি না করে কলমে কলমেই ভালো । আষাঢ় ১২৯৯ 8 তুমি লিখছ যে, প্রাচীন সাহিত্যের মধ্যে তত্ত্বের প্রাদুর্ভাব ছিল না। তখন সাহিত্য অখণ্ডভাবে দেখা দিত, তাকে দ্বিধাবিভক্ত করে তার মধ্যে থেকে তত্ত্ব প্রকাশ হয়ে পড়ত না । সেই দৃষ্টান্ত দেখিয়ে তুমি বলতে চাও যে, সাহিত্যের সঙ্গে জীবনের মূলতত্ত্বের কোনো অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ নেই, ওটা কেবল আকস্মিক সম্বন্ধ । এর থেকে বেশ দেখা যাচ্ছে, তোমাতে আমাতে কেবুল ভাষা নিয়ে তর্ক চলছে । আমি যাকে মূলতত্ত্ব বলছি তুমি সেটা ঠিক গ্ৰহণ কর নি— এবং অবশেষে সেজন্য আমাকেই হয়তো ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। যদিও মূলতত্ত্ব শব্দটাকে বারংবার ব্যাখ্যা করতে আমি ত্রুটি করি নি। এবারকার চিঠিতে ঐ কথাটা পরিষ্কার করা যাক । প্রাচীন কালের লোকেরা প্রকৃতিকে এবং সংসারকে যেরকম ভাবে দেখত আমরা ঠিক সে ভাবে দেখি নে ! বিজ্ঞান এসে সমস্ত জগৎসংসারের মধ্যে এমন একটা দ্রাবক পদার্থ ঢেলে দিয়েছে যাতে করে সবটা ছিড়ে গিয়ে তার ক্ষীরা এবং নীর, ছানা এবং মাখন স্বতন্ত্র হয়ে গেছে। সুতরাং বিশ্ব সম্বন্ধে মানুষের মনের ভাব যে অনেকটা পরিবর্তিত হয়ে গেছে তার আর সন্দেহ নেই ; বৈদিক কালের ঋষি যে ভাবে উদ্যাকে দেখতেন এবং স্তব করতেন আমাদের কালে উদ্যা সম্বন্ধে সে ভাব সম্পূর্ণ সম্ভব নয়।