পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য · · ° ○○ মধ্যে কোথাও রাজসিংহাসন দেওয়া যায়। তবে তাকে কে মানবে ? কিন্তু পেটুকতা কি পৃথিবীতে অসত্য ? সেটা কি আমাদের অনেকানেক মহৎবৃত্তির চেয়ে অধিকতর সাধারণব্যাপী নয় ? কিন্তু তাকে আমাদের সমগ্ৰ মনুষ্যত্বের প্রতিনিধি করতে আমাদের একান্ত আপত্তি, এইজন্যে সাহিত্যে তার স্থান। নেই। কিন্তু কোনো ‘জোলা’। যদি পেটুকতাকে তঁর নভেলের বিষয় করেন এবং কৈফিয়ত দেবার বেলায় বলেন যে, পেটুকতা পৃথিবীতে একটা চিরসত্য, অতএব ওটা সাহিত্যের মধ্যে স্থান না পাবে কেন, তখন আমরা উত্তর দেব ; সাহিত্যে আমরা সত্য চাই নে, মানুষ চাই। যেমন পেটুকতা, অন্য অনেক শারীরিক বৃত্তিও তেমনি । তারা ঠিক রাজবংশীয় ক্ষত্ৰিয় নয়, তারা শূদ্র দাস ; তারা দুর্বল দেশে মাঝে মাঝে রাজসিংহাসন হরণ করে নেয়, কিন্তু মানব-ইতিহাসে কখনো কোথাও কোনাে স্থায়ী গীেরব লাভ করে নি- সমাজে তাদের চরম এভোলুশন হচ্ছে কেবল ফরাসি রান্না এবং ফরাসি নভেল। সমগ্ৰতাই যদি সাহিত্যের প্রাণ না হত তা হলে জেলার নভেলের কোনো দোষ দেখতুম না। তার সাক্ষী, বিজ্ঞানে কোনো অশ্লীলতা নেই। সে খণ্ড জিনিসকে খণ্ড ভাবেই দেখায়। আর, সাহিত্য যখন মানবপ্রকৃতির কোনো-একটা অংশের অবতারণা করে তখন তাকে একটা বৃহতের, একটা সমগ্রের প্রতিনিধিস্বরূপে দাড় করায় ; এইজন্যে আমাদের মানসগ্রামের বড়ো বড়ো মোড়লগুলিকেই সে নির্বাচন করে নেয় । i কথাটা আমাদের আলোচ্য বিষয়ের ঠিক সমরেখায় পড়ল কি না জানি নে । কিন্তু আমি যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা এর দ্বারা কতকটা পরিস্ফুট হবে বলেই এর অবতারণা করা গেছে। অতএব আমার বক্তব্য এই যে, সাহিত্য মোট মানুষের কথা । শেকসপীয়র এবং প্রাচীন কবিরা মানুষ দেখতে পেতেন এবং তাদের প্রতিকৃতি সহজে দিতে পারতেন। এখন আমরা এক-একটা অর্ধচেতন অবস্থায় নিজের অন্তস্তলে প্রবেশ করে গুপ্তমানুষকে দেখতে পাই | সচেতন হলেই চির-অভ্যাস-ক্রমে সে লুকিয়ে পড়ে। এইজন্যে আজকালকার লেখায় প্রায় লেখকের বিশেষত্বের মধ্যেই মনুষ্যত্ব দেখা দেয় । কিংবা খণ্ড খণ্ড আভাসকে কল্পনাশক্তির দ্বারা জুড়ে এক করে গড়ে তুলতে হয়। অন্তররাজ্যও বড়ো জটিল হয়ে পড়েছে, পথও বড়ো গোপন । যাকে ইংরাজিতে ইনস্পিরশন বলে সে একটা মুগ্ধ অবস্থা ; তখন লেখক একটা অর্ধচেতন শক্তির প্রভাবে কৃত্রিম জগতের শাসন অনেকটা অতিক্রম করে এবং মনুষ্যরাজার যেখানে খাস দরবার সেই মর্মসিংহাসনের সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়। কিন্তু নিজের সুখদুঃখের দ্বারাই হােক আর অন্যের সুখদুঃখের দ্বারাই হােক, প্রকৃতির বর্ণনা করেই হােক আর মনুষ্যচরিত্র গঠিত করেই হােক, মানুষকে প্রকাশ করতে হবে। আর-সমস্ত উপলক্ষ । প্রকৃতিবর্ণনাও উপলক্ষ ; কারণ, প্রকৃতি ঠিকটি কিরূপ তা নিয়ে সাহিত্যের কোনাে মাথাব্যথাই নেই, কিন্তু প্রকৃতি মানুষের হৃদয়ে, মানুষের সুখদুঃখের চারি দিকে, কিরকম ভাবে প্রকাশিত হয় সাহিত্য তাই দেখায়। এমন-কি, ভাষা তা ছাড়া আর-কিছু পারে না। চিত্রকর যে রঙ দিয়ে ছবি আঁকে সে রঙের মধ্যে মানুষের জীবন মিশ্রিত হয় নি; কিন্তু কবি যে ভাষা দিয়ে বর্ণনা করে তার প্রত্যেক শব্দ আমাদের হৃদয়ের দোলায় লালিত পালিত হয়েছে। তার মধ্যে থেকে সেই জীবনের মিশ্রণী:টুকু বাদ দিয়ে ভাষাকে জড় উপাদানে পরিণত করে নিছক বর্ণনাটুকু করে গেলে যে কাব্য হয় এ কথা কিছুতে স্বীকার করা যায় না। সৌন্দর্যপ্রকাশও সাহিত্যের উদ্দেশ্য নয়, উপলক্ষ মাত্র। হ্যামলেটের ছবি সৌন্দর্যের ছবি নয়, মানবের ছবি ; ওথেলোর অশান্তি সুন্দর নয়, মানবস্বভাবগত। কিন্তু সৌন্দৰ্য কী গুণে সাহিত্যে স্থান পায় বলা আবশ্যক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে মানবহৃদয়ের একটা নিত্য মিশ্রণ আছে। তার মধ্যে প্রকৃতির জিনিস যতটা আছে তার চেয়ে মানবের চিত্ত বেশি। এইজন্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে মানব আপনাকেই অনুভব করে। প্রকৃতির সৌন্দর্যসম্বন্ধে যতই সচেতন হব প্রকৃতির মধ্যে আমারই হৃদয়ের ব্যাপ্তি তত বাড়বে।