পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ Տ8 4 রবীন্দ্র-রচনাবলী করিয়া শুভকে উজ্জ্বলতর করিয়া তোলে। ফলের বীজ যেখানে পড়ে সেইখানেই অঙ্কুরিত হইতে যদি নুশুবাদ তাহাকে অন্যত্র উড়াইয়া ইয়া যায়, শুধু সে ব্যৰ্থ হয়ন, উপযুক্ত সুযোগে ভালেই থাকে । f কিন্তু কলিকাতা বড়োই কঠিন স্থান। এ তো বরিশাল নয়। এ যে রাজবাড়ির শান-বাধানো আঙিনা। এখানে কেবল কাজ, কৌতুক ও কৌতুহল, আনাগোনা এবং উত্তেজনা। এখানে হৃদয়ের বীজ অঙ্কুরিত হইবে কোথায় ? জিজ্ঞাসা করি, এখানে হৃদয় দিয়া মিলনসভাকে আহবান করিতেছে কে ? এ সভার কোনো প্রয়োজন কি কেহ বেদনার সহিত নিজের অন্তরের মধ্যে অনুভব করিয়াছে ? এখানে ইহা নানা আয়োজনের মধ্যে একটিমাত্র, সর্বদাই নানাপ্রকারে জনতা-মহারাজের মন ভুলইয়া রাখিবার এক শত অনাবশ্যক ব্যাপারের মধ্যে এটি এক-শত—এক । জনতা-মহারাজকে আমিও যথেষ্ট সম্মান করি, কিন্তু কিঞ্চিৎ দূর হইতে করিতে ইচ্ছা করি। র্তাহার সেবক-পরিচারকের অভাব নাই। আমিও মাঝে মাঝে র্তাহার দ্বারে হাজিরা দিয়াছি, হাততালির বেতনও আদায় করিয়া লইয়াছি, কিন্তু সত্য কথাই বলিতেছি, সে বেতনে চিরদিন পেট ভরে না ; এখন ছুটি লইবার সময় হইয়াছে। বর্তমান সভার কর্তৃপক্ষদের কাছে কাতরকণ্ঠে ছুটির দরখাস্ত করিয়াছিলাম। র্তাহারা আমার পূর্বেকার নােকরি স্মরণ করিয়া দরখাস্ত নামঞ্জুর করিয়াছেন। তাহারা কেহ বা আমার প্রিয় আত্মীয়, কেহ বা আমার মান্য ব্যক্তি ; তঁহাদের অনুরোধের উত্তরে 'না' বলিবার অভ্যাস এখনো পাকে নাই বলিয়া যেখানেই তাহারা আমাকে দাড় করাইয়া দিলেন সেইখানেই আসিয়া দাড়াইলাম । কিন্তু সকলেরই তো আমি প্রিয় ব্যক্তি এবং আত্মীয় ব্যক্তি নাহি ; অতএব এখানে দাড়াইবার আমার অধিকার কী আছে, পক্ষপাতহীন বিচারকদের কাছে তাহারও জবাবদিহি আমাকে করিতে হইবে । জনতা-মহারাজের চাপরাস বহন করিবার এও একটা বিভ্ৰাট । ” করাটাকেই আমি বিনয় বলিয়া মনে করি নাই । অতএব আমি যে প্রথম সাহিত্যসম্মিলনসভার সভাপতির পদে বৃত হইয়াছিলাম, সে সম্মান আমার পক্ষে আনন্দের সহিত শিরোধার্য। জীবনে যাচিত এবং অযাচিত সৌভাগ্য তো মাঝে মাঝে ঘটে, নিজের যোগ্যতা বিচার করিয়া সেই সৌভাগ্য গ্ৰহণ করিবার ভার যদি নিজেরই উপরে থাকে, তবে পৃথিবীতে কয়জন ধনী অসংকোচে ধন ভোগ করিতে এবং কয়জন মানী নির্বিচারে মানের দাবি করিতে পারেন ? তবে তো পৃথিবীর বিস্তর বড়ো বড়ো পদ ও পদবী কুলীনকন্যার মতো উপযুক্ত পাত্রের অপেক্ষায় অনাথ অবস্থাতেই দিনযাপন করিতে বাধ্য হয়। এমন-সকল দৃষ্টান্তসত্ত্বেও আমিই যে কেবল সম্মান ছাড়িয়া দিয়া বিনয় প্রদর্শন করিব এত বড়ো আলোকসামান্য ন্যায়ভীরুতা আমার নাই । ] যেমন করিয়াই হউক, বরিশালের সভায় যে অধিকার পাইয়াছি সেই অধিকারের জোরেই আজ কলিকাতার মতো স্থানেও এখানে দাড়াইতে সংকোচ দূর করিলাম। আজিকার এই সভাকে আমি বরিশালের সেই সম্মিলনসভারই অনুবৃত্তি বলিয়া গণ্য করিতেছি। বরিশালের সেই আহবান ও আতিথ্যকেই সর্বাগ্রে স্বীকার করিয়া লইয়া আজিকার কর্মে প্রবৃত্ত হওয়া উচিত। তার পরে কথা এই কাজটা কী ? বরিশালের নিমন্ত্রণাপত্রে ঘোষণা করা হইয়াছিল যে, সভার উদ্দেশ্য সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রতিস্থাপন ও মাতৃভাষার উন্নতিসাধন । এই দুটি উদ্দেশ্যের দিকে হাল বাগাইয়া চলিতে হইবে । কিন্তু পথটি তো সোজা নয়। সভাস্থাপন করিয়া প্রতিস্থাপন হয়, বাংলাদেশে তাহার প্রমাণ তো সর্বদা পাওয়া যায় না ; বরঞ্চ উলটা হয় এমন দৃষ্টান্ত অনেক দেখানো যাইতে পারে। গ্ৰীতিবিধান ও উন্নতিসাধন, জগতে এ দুটি বৈ আর তো সাধু উদ্দেশ্য নাই। এ দুটির সহজপথ-আবিষ্কার-চেষ্টায় ধরাতল বারংবার অশ্রু এবং রক্তে অভিষিক্ত হইয়াছে, তবু আজও এক ব্ৰতের ব্ৰতী, এক ব্যবসায়ের ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঈর্ষা-কলহের অন্ত নাই- আজও উন্নতি-অবনতি চাকার মতো আবর্তিত হইতেছে এবং সংসারের উন্নতির জন্য চেষ্টা করিতেছে অগণ্য লোক এবং