পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৭১৮ - রবীন্দ্র-রচনাবলী করে। বৈষ্ণবধর্মপ্লাবনের সময় বিশ্বপ্ৰেম যেদিন বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে সমস্ত কৃত্রিম সংকীর্ণতার বেড়া ভাঙিয়া দিয়া উচ্চনীচ শুচি-অশুচি সকলকেই এক ভগবানের আনন্দলোকে আহবান করিল সেইদিনকার বাংলাদেশের গান বিশ্বের গান হইয়া জগতের নিত্যসাহিত্যে স্থান পাইয়াছে। কিন্তু শুষ্কধর্ম যখন সৰ্বমানবের মহেশ্বরকে দূরে রাখিয়া মানুষের মধ্যে কেবল বাছ-বিচার এবং ভেদ-বিভেদের সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম সীমবিভাগ করিতে ব্যগ্র হয় তখন সাহিত্যের রসপ্লাবন শুষ্ক হইয়া যায়, কেবল বৈষ্ণবকাব্যই আমাদের দেশের সাহিত্যকে প্রথম রাজসভার সংকীর্ণ আশ্রয় হইতে বৃহৎভাবে জনসমাজের মধ্যে বাহির করিয়া আনিল। পর্বতের গুহা ভেদ করিয়া ঝর্না বাহির হইল। কিন্তু নানা দিক হইতে নানা ধারা আসিয়া না জুটিলে নদী হয় না। আজ বাংলায় গদ্যে-পদ্যে-সম্মিলিত সাহিত্য বাঙালি জনসাধারণের হৃদয় হইতে বিচিত্ৰ ভাবস্রোত বিবিধ জ্ঞানপ্রবাহ অহরহ আকর্ষণ করিয়া পরিপুষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। এই সাহিত্যেই বাংলার উত্তরদক্ষিণ পূর্বপশ্চিম সমস্ত প্রদেশ নিরন্তর আপনাকে মিলিত করিতেছে। নিখিল বাঙালির এই হৃদয়সংগমস্থলই বাঙালির সর্বপ্রধান মিলনতীর্থ। এই তীর্থেই আমাদের জাগ্ৰত দেবতার নিত্য অধিষ্ঠান হইবে এবং এইখানেই আমরা আমাদের সমস্ত যত্ন গ্ৰীতি ও নৈপুণ্যের দ্বারা এমন ধর্মশালা নির্মাণ করিব যেখানে চিরদিন আমাদের উত্তরকালীন যাত্রিগণ আশ্রয় লাভ করিতে পরিবে। সাহিত্যের নামে আমরা আজ এই-যে মিলনের সভা আহবান করিয়াছি। এই মিলনের বিশেষ সার্থকতা প্রমাণ করিবার জন্য সাহিত্যের মূলতত্ত্বের প্রতি আপনাদের মনােযোগ প্রবৃত্ত করিতে চেষ্টা করিলাম। রাজনৈতিক মিলনের মধ্যে বিরোধের বীজ আছে, তাহাতে পরজাতির সহিত সংঘাত আছে ; কিন্তু আমাদের সাহিত্যের মিলন বিশুদ্ধ মিলন, তাহাতে পরের প্রতি বিরোধ দৃষ্টি দিবার কোনাে প্রয়ােজন নাই— তাহা একান্তভাবে স্বজাতির কল্যাণকর। বঙ্গসাহিত্যে বাঙালি নিজের যে পরিচয় পাইয়াছে তাহা তাহার আত্মশক্তি হইতেই উদ্ভূত, এই কারণে সাহিত্যসম্মিলনে আমরা ক্ষুন্ন অভিমানের দৰ্পে অন্যের প্রতি তর্জন গর্জন করিয়া তৃপ্তিলাভের চেষ্টা করিব না। দুর্ভাগ্যক্রমে বর্তমানে আমাদের এমন সময় আসিয়াছে। যখন নানা পীড়নে নানা তাড়নায় আমরা পরসংঘাতের বেদনা এক মুহুর্তের জন্যও ভুলিতে পারিতেছি না- এরূপ অবস্থা ব্যাধির অবস্থা। এমন অবস্থায় আমাদের প্রকৃতি তাহার স্বাভাবিক ক্রিয়া সম্পন্ন করিতে পারে না। কিন্তু পরজাত বেদনা ক্ষণকালের জন্য ভুলিয়া নিজের মধ্যে আমরা যদি শান্তি ও প্রতিষ্ঠা অনুভব করিতে চাই, যদি নানা দুৰ্যোগের মধ্যেও আশার ধ্রুবতারাকে উজ্জ্বলরাপে দেখিয়া আমরা বরলাভ করিতে ইচ্ছা করি, তবে এই সাহিত্যের সম্মিলনই তাহার উপায়। যেখানে বেদনা সেইখানেই স্বভাবত বারংবার হাত পড়ে বটে, কিন্তু ব্যথাকে বারংবার স্পর্শদ্বারা ব্যথিততর করিয়া তোলাই আরোগ্যের উপায় নহে। সেই বিশেষ বেদনাকে ভুলিয়া সমস্ত দেহের আভ্যন্তরিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন প্রয়ােগ করিলে যথাসময়ে এই বেদনা ক্ষীণ হইয়া আসে। আমাদিগকেও এইরূপ চিকিৎসা অবলম্বন করিতে হইবে ; দিনরাত্রি কেবল অসুখের প্রতিই সমস্ত লক্ষ নিবদ্ধ রাখিলে আমাদের কল্যাণ হইবে না। যেখানে আমাদের বল, যেখানে আমাদের গীেরব, সেখানেই সর্বপ্রযত্নে আমাদের চেতনাকে জাগ্ৰত করিয়া তুলিলে তবেই আমাদের মধ্যে প্রকৃত স্বাস্থ্যসঞ্চার হইতে থাকিবে । কিন্তু এ-সব তো গেল ভাবের কথা । কাজের কথা কি আমাদের সভার মধ্যে পাড়িবার কোনো স্থান नाट्रै ? w সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে পরস্পর প্রতিস্থাপন কল্যাণকর সন্দেহ নাই, সাহিত্যিকদের মধ্যেও গ্ৰীতিবন্ধন যদি ঘনিষ্ঠ হয় সে তো ভালো কথা, কিন্তু বিশেষভাবে সাহিত্যিকদের মধ্যেই গ্ৰীতিবিস্তারের যে বিশেষ ফল আছে তাহা মনে করি না । অর্থাৎ লেখকগণ পরস্পরকে ভালোবাসিলেই যে তাহদের রচনাকার্যের বিশেষ উপকার ঘটে এমন কথা বলা যায় না। ব্যবসায় হিসাবে সাহিত্যিকগণ বিচ্ছিন্ন, স্ব-স্ব-প্রধান ; তাহারা পরস্পর পরামর্শ করিয়া জোট করিয়া সাহিত্যের যৌথ-কারবার করেন না ।