পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য ԳՀ ֆ আন্তরিক ঔদাসীন্য- সেই সকল কাজেই আশাপথে নূতনপ্রবৃত্ত তরুণ জীবনগুলিকে উৎসর্গ করিতে হইবে। সেইজন্য বিশেষ করিয়া আজ ছাত্রদের দিকে চাহিতেছি। এ সভায় ছাত্ৰসম্প্রদায়ের যাহারা উপস্থিত আছেন আমি তাহাদিগকে বলিতে পারি, প্রৌঢ়বয়সের শিখরদেশে আরোহণ করিয়াও আমি ছাত্রগণকে, সুদূর প্রবীণত্বের চক্ষে একদিনও ছােটাে করিয়া দেখি নাই। বয়স্কমণ্ডলীর মধ্যে যখন দেখিতে পাই তাহারা পুঁথিগত বিদ্যা লইয়াই আছেন, প্রত্যক্ষ ব্যাপারের সজীব শিক্ষাকে তাহারা আমল দেন না- যখন দেখি চিরাভ্যন্ত একই চক্রপথে শতসহস্রবার পরিভ্রান্ত হইবার এবং চিরাচ্চারিত বাক্যগুলিকেই উচ্চকণ্ঠে পুনঃপুনঃ আবৃত্তি করিবার প্রতি তীহাদের অবিচলিত নিষ্ঠা— তখন ছাত্রদিগের জ্যোতিঃপিপাসু বিকাশেমুখ তারুণ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াই আমি চিত্তের অবসাদ দূর করিয়াছি। দেশের ভবিষ্যৎকে র্যাহারা জীবনের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে বহন করিয়া শনৈঃ শনৈঃ উদয়পথে অধিরোহণ করিতেছেন তাহাদিগকে অনুনয়-সহকারে জন্মে। তবে তাহারা কেবল পণ্ডপাণ্ডিত্য লাভ করিবেন, জ্ঞানলাভ করিবেন না। এ দেশ হইতে কৃষিজাত ও খনিজ দ্রব্য দূরদেশে গিয়া ব্যবহার্য পণ্য-আকারে রূপান্তরিত হইয়া এ দেশে ফিরিয়া আসে ; পণ্যসম্বন্ধে এইরূপ দুর্বল পরনির্ভরতা পরিত্যাগ করিবার জন্য সমাজ দৃঢ়সংকল্প হইয়াছেন। বস্তুত ঔদাসীন্য ও অজ্ঞতা -বশত দেশের বিধাতৃদত্ত সামগ্ৰীকে যদি আমরা ব্যবহারে না লাগাইতে পারি। তবে দেশের দ্রব্যে আমাদের কোনাে অধিকারই থাকে না, আমরা কেবল মজুরি মাত্র করি। আমাদের এই লজ্জাজনক দৈন্য দূর করার সম্বন্ধে ছাত্রদের মনে কোনো দ্বিধা নাই। কিন্তু জ্ঞানের সম্বন্ধেও ছাত্রদিগকে এই একই ভাবে সচেতন হইতে হইবে। দেশের বিষয়ে আমাদের যাহা-কিছু শিক্ষণীয় বিদেশীর হাত দিয়া প্রস্তুত হইয়া বিদেশীর মুখ দিয়া উচ্চারিত হইলে তবেই তাহা আমরা কণ্ঠস্থ করিব, দেশের জ্ঞানপদার্থে আমাদের স্বায়ত্ত অধিকার থাকিবে না, দেবী ভারতীকে আমরা বিলাতি স্বর্ণকারের গহনা পরাইতে থাকিব, এ দৈন্য আমরা আর কত দিন স্বীকার করিব ! আজি আমাদের যে ছাত্ৰগণ দেশী মোটা কাপড় পরিতেছেন ও স্বহস্তে তাত বোনা শিখিতেছেন, তাহাদিগকে দেশের সমস্ত বৃত্তান্তসংগ্রহেও স্বদেশী হইতে হইবে। প্রত্যেক ছাত্র অবকাশকালে নিজের নিবাসপ্রদেশের ধর্মকর্ম ভাষাসাহিত্য বাণিজ্য লোকব্যবহার ইতিহাস জনশ্রুতির বিবরণ সাধ্যমত । আহরণ করিতে চেষ্টা করিবেন। এ কথা মনে রাখিতে হইবে, ইহাদের সকলেরই সংগ্ৰহ যে আমাদের সাহিত্যে ব্যবহারযোগ্য হইবে, তাহা নহে, কিন্তু এই উপায়ে স্বাধীন জ্ঞানার্জনের উদ্যম তাহদের গ্রন্থভারক্লিষ্ট মনের জড়তা দূর করিয়া দিবে এবং দেশের কোনাে পদার্থকেই তুচ্ছ জ্ঞান না করিবার এবং দেশী সমস্ত জিনিসই নিজে দেখিবার শুনিবার ও বুঝিবার চেষ্টা তাহাদিগকে যথার্থ স্বদেশগ্ৰীতির দিকে অগ্রসর এবং স্বদেশসেবার জন্য প্রস্তুত করিবে। কোনো গ্ৰীতিই সম্পূর্ণ অকৃত্রিম ও পরিপক্ক হইতেই পারে না, যদি তাহা প্রত্যক্ষজ্ঞানের উপরে প্রতিষ্ঠিত না হয়। ভালোবাসা অক্লান্ত যত্নে জানিতে ইচ্ছা! করে এবং জানা হইলে ভালোবাসা আরো সত্য ও সুগভীর হয় । আমাদের স্বদেশপ্রেমের সেই ভিত্তির অভাব আছে এবং আমাদের মনে সেই ভিত্তিবাচনার জন্য যদি দুনিবার আগ্রহ উপস্থিত না হয় তবে যেন আমরা স্বদেশপ্রেমের অভিমান না করি। যদি এই প্রেমের অভিমানী হইবার প্রকৃত অধিকার আমরা না লাভ করিতে পারি। তবে স্বদেশ আমাদের স্বদেশ নহে। জ্ঞানের দ্বারা, প্রেমের দ্বারা, সেবার । দ্বারা, পরিপূর্ণ ব্যবহারের দ্বারাই অধিকার লাভ করা যায়। জগতে যে জাতি দেশকে ভালোবাসে সে অনুরাগের সহিত স্বদেশের সমস্ত সন্ধান নিজে রাখে, পরের পুঁথির প্রত্যাশায় তাকাইয়া থাকে না ; স্বদেশের সেবা যথাসাধ্য নিজে করে, কেবল পরের কর্তব্যবোধকে জাগ্ৰত করিবার উপায় সন্ধান করে না। ; এবং দেশের সমস্ত সম্পদকে নিজের সম্পূর্ণ ব্যবহারে আনিতে চেষ্টা করে, বিদেশী ব্যবসায়ীর অশুভাগমনের প্রতীক্ষায় নিজেকে পথের কাঙািল করিয়া রাখে না। তাই আজ আমি আমাদের ছাত্রগণকে বলিতেছি, দেশের উপরে সর্বাগ্রে সর্বপ্রযত্নে জ্ঞানের অধিকার বিস্তার করে, তাহার পরে প্রেমের এবং কর্মের অধিকার সহজে প্রশস্ত হইতে থাকিবে। 8||8や