পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ԳՀՀ রবীন্দ্র-রচনাবলী আজ আমি বাংলাদেশের দুই বিভিন্ন কালের উদয়াস্তসন্ধিস্থলে দাড়াইয়া, হে ছাত্ৰগণ, কবির বাণী স্মরণ করিতেছি যাত্যেকতোহস্তশিখরং পতিরোষধীনাম। আবিষ্কৃতারুণপুরঃসর একতোহািৰ্কং | এখন আমাদের কালের সিতরশ্মি চন্দ্ৰম অস্তমিত হইতেছে, তোমাদের কালের তেজ-উদভাসিত সূর্যোদয় আসন্ন— তোমরা তাহারই অরুণসারথি । আমরা ছিলাম দেশের সুপ্তিজালজড়িত নিশীথে ; অন্যত্র হইতে প্রতিফলিত ক্ষীণজ্যোতিতে আমরা দীর্ঘরাত্রি অপরিস্ফুট ছায়ালোকের মায়া বিস্তার করিতেছিলাম। আমাদের সেই কর্মহীন কালে কত অলীক বিভ্রম এবং অকারণ আতঙ্ক দিগন্তব্যাপী অস্পষ্টতার মধ্যে প্রেতের মতো সঞ্চরণ করিতেছিল। আজ তোমরা পূৰ্বৰ্গগনে নিজের আলোকে দীপ্তিমান হইয়া উঠিতেছ। এখনো জল স্থল আকাশ নিস্তব্ধ হইয়া নবজীবনের পূর্ণবিকাশের জন প্রতীক্ষা করিয়া আছে ; অনতিকাল পরেই গৃহে গৃহে, পথে পথে কর্মকোলাহল জাগ্রত হইয়া উঠিবে। তীক্ষদৃষ্টির সম্মুখে উদভাসিত হইয়া উঠিবে। তখন তোমাদের কবিবিহঙ্গগণ আকাশে যে গান গাহিবে তাহাতে অবসাদের আবেশ ও সুপ্তির জড়িমা থাকিবে না ; তাহা প্রত্যক্ষ আলোকের আনন্দে, তাহা করতলালব্ধ সত্যের উৎসাহে, সহস্র জীবন হইতে সহস্র ধারায় উচ্ছসিত হইয়া উঠিবে । এই জ্যোতির্ময় আশাদীপ্ত প্ৰভাতকে সুমহান সুন্দর পরিণামে বহন করিয়া লইবার ভার তোমাদের হস্তে সমর্পণ করিয়া আমরা বিদায়ের নেপথ্যপথে যাত্ৰা করিতে উদ্যত হইলাম। তোমাদের উদয়পথ মেঘনিমুক্ত হউক, এই আমাদের আশীর্বাদ । ফায়ুন ১৩১৩ সাহিত্যপরিষৎ বাংলাদেশের স্থানে স্থানে সাহিত্যপরিষদের শাখাস্থাপন ও বৎসরে বৎসরে ভিন্ন ভিন্ন জেলায় পরিষদের বাৎসরিক মিলনোৎসব -সাধনের প্রস্তাব অন্তত দুইবার আমার মুখ দিয়া প্রচার হইয়াছে। তাহাতে কী উপকারের আশা করা যায় এবং তাহার কার্যপ্ৰণালী কিরূপ হওয়া উচিত তাহাও সাধ্যমত আলোচনা করিয়াছি। অতএব তৃতীয়বারে আমাকে বিশ্রাম করিতে দেওয়া উচিত ছিল। একই জমিতে একই ফসল বার বার চাষ করিতে গেলে ফলন ভালো হয় না, নিঃসন্দেহই আমার সুহৃদগণ সে কথা জানেন ; কিন্তু তাহারা যে ফলের প্রতি দৃষ্টি না করিয়াও আমাকে সভাস্থলে পুনশ্চ আকর্ষণ করিলেন এর কারণ তো আর কিছু বুঝি না, এ কেবল আমার প্রতি পক্ষপাত । এই অকারণ পক্ষপাত ব্যাপারটার অপব্যয় অন্যের সম্বন্ধে সহ্য করা অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু নিজের সম্বন্ধে সেটা তেমন অতুগ্র অন্যায় বলিয়া ঠেকে না— মনুষ্যস্বভাবের এই আশ্চর্যধর্মবিশত আমি বন্ধুদের আহবান অমান্য করিতে পারিলাম না । ইহাতে যদি আমার অপরাধ হয় ও আমাকে অপবাদ সহ্য করিতে হয় তাহাও স্বীকার করিতে হইবে । পূর্বে আমাদের দেশে পাল-পার্বণ অনেক রকমের ছিল ; তাহাতে আমাদের একঘেয়ে একটানা জীবনের মাঝে মাঝে নাড়া দিয়া ঢেউ তুলিয়া দিত। আজকাল সময়াভাবে অন্নাভাবে ও শ্রদ্ধার অভাবে সে-সকল পার্বণ কমিয়া আসিয়াছে । এখন সভা-সমিতি-সম্মিলন সেই-সকল পার্বণের জায়গা দখল করিতেছে । এইজন্য শহরে-মফস্বলে কতরকম উপলক্ষে কতপ্রকার নাম ধরিয়া কত সভাস্থাপন হইতেছে সেইসকল সভায় দেশের বক্তাদের বক্তৃতার পালা জমাইবার জন্য কত চেষ্টা ও কত আয়োজন হইয়া থাকে তাহা সকলেই জানেন । অনেকে এই-সকল চেষ্টাকে নিন্দা করেন ও এই-সকল আয়োজনকে হুজুগ বলিয়া উড়াইয়া দিয়া