পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য १२७ থাকেন। বাংলাভাষায় এই হুজুগ শব্দটা কোথা হইতে আসিল তাহা আমাদের পরিষদের শব্দতাত্ত্বিক মহাশয়গণ স্থির করবেন ; কিন্তু এটা যে আমাদের সমাজের শনিগ্রহের রচনা, আমার তাহাতে সন্দেহ ? নাই। নিজের জড়ত্বকে অন্য লোকের উৎসাহের চেয়ে বড়ো পদবী দিবার জন্যই প্রায় আচল লোকেরা এই শব্দটা ব্যবহার করিয়া দেশের সমস্ত উদ্যমের মূলে হুল ফুটাইবার চেষ্টা করিয়া থাকে। দেশের মধ্যে কিছুকাল হইতেই এই-যে চাঞ্চল্য দেখা যাইতেছে এটা যদি হুজুগ হয় তো হােক । আমাদিগকে ভুল করিতে দাও, গোল করিতে দাও, বাজে কাজ করিতে দাও, পাচজন লোককে । ডাকিতে ও পাচ জায়গায় ঘুরিতে দাও । এই নড়াচড়া চলুক। এই নড়াচড়ার দ্বারাই যেটা যে ভাবে গড়িবার সেটা ক্ৰমে গড়িয়া ওঠে, যেটা বাহুল্য সেটা আপনি বাদ পড়ে, যেটা বিকৃতি সেটার সংশোধন হইতে থাকে । বিবেচকভাবে চুপচাপ করিয়া থাকিলে তাহার কিছু হয় না। আমাদের মনটা যে স্থির হইয়া নাই, দেশের নানা স্থানেই যে ছােটােবড়ো ঘূর্ণবেগ আজকাল কেবলই প্রকাশ পাইতেছে, ইহাতে বুঝা যাইতেছে একটা সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলিতেছে। ঘুরিতে ঘুরিতে জ্যোতির্বােম্পই যে কেবল আকার ধারণ করে তাঁহা নহে, মানুষের মনগুলি যখন গতির বেগ পায় তখন তাহারা জমাট বাধিয়া একটা-কিছু গঠন না করিয়া থাকিতে পারে না। অন্তত, আমরা যদি কিছু গড়িয়া তুলিতে চাই। তবে এই প্রকার বেগবান অবস্থাই তাহার পক্ষে অনুকূল। কুমোরের চাকা যখন ঘুরিতে থাকে তখনই কুমের যাহা পারে গড়িয়া লয় ; যখন তাহা স্থির থাকে তখন তাহার কাছে প্রত্যাশা করিবার কিছুই থাকে না। আজ দেশের মধ্যে চারি দিকে যে একটা বেগের সঞ্চার দেখা যাইতেছে তাহাতেই হঠাৎ দেশের কাছে আমাদের সমস্ত প্রত্যাশাই বাডিয়া গেছে। আমাদের যাহার মনে যে উদ্দেশ্য আছে। এই বেগের সুযোগে তাহা সিদ্ধ করিয়া লইবার জন্য আমরা সকলেই চকিত হইয়া উঠিয়াছি। আজ আমরা দশজনে যে-কোনো উপলক্ষে একত্র হইলেই তাহার মধ্য হইতে কিছু-একটা মথিয়া উঠিবে, এমন ভরসা হয় । এইরকম সময়ে যাহা অনপেক্ষিত তাহাও দেখা দেয়, যাহাকে আশা করিবার কোনো কারণ ছিল না। তাহাও হঠাৎ সম্ভব হইয়া উঠে, আমাদের প্রত্যেকের শক্তি সামান্য হইলেও সমস্ত সমাজের বেগে ক্ষণে ক্ষণে অসাধ্যসাধন হইতে থাকে । আজ আমাদের সাহিত্যপরিষদেরও আশা বাড়িয়া গেছে। এই-যে এখানে নানা জেলা হইতে আমরা বাঙালি একত্র হইয়াছি, এখানে শুধু একটা মিলনের আনন্দেই এই সম্মিলনকে শেষ করিয়া দিয়া যাইব এমন আমরা মনে করি না ; হয়তো এইবারেই, ফল যেমন যথাসময়ে ডাল ছাড়িয়া ঠিকমত জমিতে পড়ে ও গাছ হইবার পথে যায়, সাহিত্যপরিষদও সেইরূপ নিজেকে বৃহৎ বাংলাদেশের মধ্যে রোপিত করিবার অবসর পাইবে । এবার হয়তো সে বৃহত্তর জন্ম লাভ করিবার জন্য বাহির হইয়াছে। আপনাদের আহবান শুধু সমাদরের আহবান নহে, তাহা সফলতার আহবান। আমরা তো এইমতেই আশা করিয়াছি । যদি আশা বৃথাই হয়, তবু মিলনটা তো কেহ কড়িয়া লইবে না ; বুদ্ধিমান কবি তো বলিয়াছেন যে, মহাবৃক্ষের সেবা করিলে ফল যদি-বা না পাওয়া যায়, ছায়াটা পাওয়া যাইবেই। কিন্তু ঐটুকু নেহাৎপক্ষের আশা লইয়াই আমরা সস্তুষ্ট হইতে পারিব না । আমরা এই কথাই বলিব, আচ্ছা, আজ যদি বা শুধু ছায়াই জুটিল, নিশ্চয়ই কাল ছায়াও পাইব, ফলও ধরিবে ; কোনােটা বাদ দিব না। সফলতা সম্বন্ধে আধা-আধি রফানিস্পত্তি করা কোনোমতেই চলিবে না। বহরমপুরের ডাকে আজ আমরা সাহিত্যপরিষদ অত্যন্ত লোভ করিয়াই এখানে আসিয়া জুটিয়াছি ; শুধু আহার দিয়া বিদায় করিলে নিন্দার বিষয় হইবে, দক্ষিণা চাই । সেই দক্ষিণার প্রস্তাবটাই আজ। আপনাদের কাছে পাড়িব । আমার দেশকে আমি যত ভালোবাসি তার দশগুণ বেশি তালোবাসা ইংরেজের কর্তব্য এ কথা আমরা মুখে বলি না, আমাদের ব্যবহারে তাঁহাই প্রকাশ পায়। এইজন্য ভারতবর্ষের হিতসাধনে বিদেশীর যতী-কিছু ত্রুটি তাহা ঘোষণা করিয়া আমাদের শ্রান্তি হয় না, আর দেশীলোকের যে ঔদাসীন্য সে সম্বন্ধে আমরা একেবারেই চুপ । কিন্তু এ কথাটার আলোচনা বিস্তর হইয়া গেছে, এমন-কি আমার আশঙ্কা হয়, কথাটা আপনার অধিকারের মর্যাদা লঙ্ঘন করিয়া ছুটিয়াছে-বা। কথা-জিনিসটার দোেষই