পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য · ዓ SÓ করিতে শুরু করিয়াছিলাম তখন সেই প্রাচীন বিবরণের জোগান পাইবার জন্য আমরা বিদেশের দিকেই অঞ্জলি পাতিয়ছিলাম ; এমন কোনো পণ্ডিত পাইলাম না যিনি স্বদেশের ইতিহাস উদ্ধার করিবার জন্য জর্মন পণ্ডিতের মতো নিজের সমস্ত চেষ্টা ও সময় এই কাজে উৎসর্গ করিতে পরিলেন। আজ আমরা স্বদেশপ্রেম লইয়া কম কথা বলিতেছি না ; কিন্তু আজও এই স্বদেশের সামান্য একটি বৃত্তান্তও যদি জানিতে ইচ্ছা করি তবে ইংরেজের রচিত পুঁথি ছাড়া আমাদের গতি নাই। এমন অবস্থায় পরের দরবারে দাবি লইয়া দাড়াই কোন মুখে, সম্মােনই বা চাই কোন লজ্জায়, আর সফলতাই বা প্রত্যাশা করি কিরূপে ? যাহার ব্যাবসা চলিতেছে বাজারে তাঁহারই ক্রেডিট থাকে, সুতরাং অন্য ধনীর কােছ হইতে সে যে সাহায্য পায় তাহাতে তাহার লজ্জার কারণ ঘটে না। কিন্তু যাহার সিকি পয়সার কারবার নাই সে যখন ধনীর দ্বারে দাঁড়ায় তখন কি সে মাথা হেঁট করিয়া দাঁড়ায় না ? এবং তখন যদি সে আঁজলা ভরিয়া কড়ি না পায়। তবে তাহা লইয়া বকাবিকি করা কি তাহার পক্ষে আরো অবমানকর নহে ? সেইজন্য আমি এই কথা বার বার বলিবার চেষ্টা করিয়াছি যে, নিজের দেশের কাজ যখন আমরা নিজেরা করিতে থাকিব তখনই অন্যের কাছ হইতেও যথোচিত কাজ আদায় করিবার বল পাইব । নিজেরা নিশ্চেষ্ট থাকিয়া কেবলমাত্র গলার জোরে যাহা পাই সেই পাওয়াতে আমাদের গলার জোর शछा उषांश-जकळ (छांशशे कशिी यांश । আমার অদৃষ্টক্রমে এই কথাটা আমাকে অনেক দিন হইতে অনেক বার বলিতে হইয়াছে এবং বলিতে গিয়া সকল সময় সমাদরও লাভ করি নাই ; এখন না বলিলেও চলে, কারণ এখন অনেকেই এই কথাই আমার চেয়ে অনেক জোরেই বলিতেছেন । কিন্তু কথা-জিনিসটার এই একটা মস্ত দোষ যে, তাহা সত্য হইলেও অতি শীঘ্রই পুরাতন হইয়া যায় এবং বরঞ্চ সত্যের হানি লোকে সহ্য করে—তবু পুরাতনত্বের অপরাধ কেহ ক্ষমা করিতে পারে না। কাজ-জিনিসটার মস্ত সুবিধা এই যে, যতদিনই তাহা চলিতে থাকে। ততদিনই তাহার ধার বাড়িয়া ওঠে। এইজন্যই বাংলাদেশের ভাষাতত্ত্ব পুরাবৃত্ত গ্ৰাম্যকথা প্রভৃতি দেশের সমস্ত ছােটােবড়ো বৃত্তান্ত সংগ্ৰহ করিবার জন্য সাহিত্যপরিষদ যখন দেশের সভার একটি ধারে আসিয়া আসন লইল আমরা আনন্দে ও গৌরবে তাহার অভিষেককার্য করিয়াছিলাম । যদি বলেন “সাহিত্যপরিষদ এতদিনে কী এমন কাজ করিয়াছে। তবে সে কথাটা ধীরে বলিবেন এবং সংকোচের সহিত বলিবেন । আমাদের দেশের কাজের বাধা যে কোথায় তাহা আমরা তখনই বুঝিতে পারি যখনই আমরা নিজেরা কাজ হাতে লই ; সে বাধা আমরা নিজেরা, আমরা প্ৰত্যেকে । যে কাজকে আমরা আমাদের কাজ বলিয়া বরণ করি তাহাকে আমরা কেহই আমার কাজ বলিয়া গ্ৰহণ করিতে এখনো শিখি নাই। সেইজন্য আমরা সকলেই পরামর্শ দিতে অগ্রসর হই, কেহই সাহায্য করিতে প্ৰস্তুত হই না ; ক্রটি দেখিলে কর্মকর্তার নিন্দা করি, অকর্মকর্তার অপবাদ নিজের উপর আরোপ করি না ; ব্যর্থতা ঘটিলে এমনভাবে আস্ফালন করি যেন কাজ নিম্বফল হইবে পূর্বেই জানিতাম এবং সেইজন্যই অত্যন্ত বুদ্ধিপূর্বক নির্বোধের উদযোগে যোগ দিই নাই। আমাদের দেশে জড়তা | লজ্জিত নহে, অহংকৃত ; আমাদের দেশে নিশ্চেষ্টতা নিজেকে গোপন করে না, উদযোগকে ধিক্কার দিয়া এবং প্রত্যেক কাজের খুঁত ধরিয়া সে নিজের শ্রেষ্ঠতা প্রমাণ করিতে চায়। এইজন্য আমাদের দেশে এ দৃশ্য সর্বদাই দেখিতে পাই যে, দেশের কাজ একটিমাত্র হতভাগ্য টানিয়া লইয়া চলিয়াছে, হাওয়া এবং স্রোত দুই উলটা, এবং দেশের লোক তীরে বসিয়া দিব্য হাওয়া খাইতে খাইতে কেহ বা প্রশংসা করিতেছে, কেহ বা লোকটার অক্ষমতা ও বিপত্তি দেখিয়া নিজেকে ধন্যজ্ঞান করিতেছে। এমন অবস্থায় দেশের অতি ক্ষুদ্র কাজটিকেও গড়িয়া তােলা কত কঠিন সে কথা আমরা যেন প্রত্যেকে বিবেচনা করিয়া দেখি । একটা ছোটাে ইস্কুল, একটা সামান্য লাইব্রেরি, একটা আমোদ করিবার দল বা একটা অতি ছােটাে রকমেরও কাজ করিবার ব্যবস্থা আমরা জাগাইয়া রাখিতে পারি না। সমুদ্রে জল থই থই করিতেছে, তাহার এক ফোটা মুখে দিবার জো নাই; আমাদের দেশেও ষষ্ঠীর প্রসাদে মানুষের অভাব নাই, কিন্তু কৰ্তব্য যখন তাহার পতাকা লইয়া আসিয়া শঙ্খধ্বনি করে তখন