পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१२७ রবীন্দ্র-রচনাবলী চারি দিকে চাহিয়া একটি মানুষ দেখিতে পাওয়া যায় না। এই-যে আমাদের দেশে কোনোমতেই কিছুই আঁট বাধে না, সংকল্পের চারি দিকে জল জমিয়া উঠে না, কোনো আকস্মিক কারণে দল বাধিলেও সকালের দল বিকাল বেলায় আলগা হইয়া আসে, এইটি ছাড়া আমাদের দেশে আর দ্বিতীয় কোনো বিপদ নাই । আমাদের এই একটিমাত্র শত্ৰু । নিজের মধ্যে এই প্ৰকাণ্ড শূন্যতা আছে বলিয়াই আমরা অনাকে গালি দিই। আমরা কেবলই কঁাদিয়া বলিতেছি : আমাদিগকে দিতেছে না । বিধাতা আমাদের কানে ধরিয়া বলিতেছেন ; তোমরা লইতেছ না । আমরা একত্ৰ হইব না, চেষ্টা করিব না, ত্যাগ করিব না, কষ্ট সহিব না কেবলই চাহিব এবং পাইব- কোনো জাতির এতবড়ো সর্বনেশে প্রশ্রয়ের দৃষ্টান্ত জগৎসংসারের ইতিহাসে তো আজ পর্যন্ত দেখা যায় নাই । তবু কেবল আমাদেরই জন্য বিশ্ববিধাতার একটি বিশেষ বিধির অপেক্ষায় আকাশে চাহিয়া বসিয়া আছি । সে বিধি আমাদের দেশে কবে চলিবে জানি না, কিন্তু বিনাশ তো সবুর করিবে না। সবুর করেও নাই ; অনশন মহামারী অপমান গৃহবিচ্ছেদ চারি দিকে জাগিয়া উঠিয়াছে। রুদ্রদেব বজ-হাতে আমাদের অনেক কালের পাপের হিসাব লইতে আসিয়াছেন ; খবরের কাগজে মিথ্যা লিখিতে পারি, সভাস্থলে মিথ্যা বলিতে পারি, রাজার চোখে ধূলা দিতে পারি, এমন-কি, নিজেকে ফাকি দেওয়াও সহজ ; কিন্তু তঁহাকে তো ভুল বুঝাইতে পারিলাম না। যাহার উপরেই দোষারোপ করি।-না কেন, রাজাই হোক বা আর যেই হোক, মরিতেছি তো আমরাই ; মাথা তো আমাদেরই হেঁট হইতেছে এবং পেটের ভাত তো আমাদেরই গেল । পরের কর্তব্যের ত্রুটি অন্বেষণ করিয়া আমাদের শ্মশানের চিতা 6ऊां निळ्नि न ! আরামের দিনে নানাপ্রকার ফাকি চলে, কিন্তু মৃত্যু সহচর বিধাতা যখন স্বয়ং দ্বারে আসিয়া দাড়াইয়াছেন তখন আজ আর মিথ্যা দিয়া হিসাব-পূরণ হইবে না। এখন আমাদের কঠোর সত্যের দিন আসিয়াছে । আজ আমরা যে-কোনো কাজকেই গ্রহণ করি।-না কেন, সকলে মিলিয়া সে কাজকে সতা করিয়া তুলিতে হইবে । দেশের যে-কোনো যথার্থ মঙ্গল-অনুষ্ঠানকে আমরা উপবাসী করিয়া ফিরাইব সেই আমাদের পৃথিবীর মধ্যে মাথা তুলিবার ও বাচিয়া থাকিবার অধিকার কিছু-না-কিছু কড়িয়া লইয়া চলিয়া যাইবে । ছোটাে হউক বড়ো হউক, নিজের হাতে দেশের যে-কোনো কাজকে সন্তা করিয়া রক্ষার উপায় হইবে । কেবল সংকল্পের তালিকা বাড়াইয়া চলিলে কোনো লাভ নাই ; কিন্তু যেমন করিয়া হউক, দেশের যথার্থ স্বকীয় একটি-একটি কাজকে সফল করিয়া তুলিতেই হইবে । সে কেবল সেই একটি বিশেষ কার্যের ফললাভ করিবার জন্য নহে ; সকল কার্যেই ফললাভের অধিকার পাইবার জন্য । কারণ থাকে, এই কথা মনে রাখিয়া দেশের কাজগুলিকে সফল করিবার দায় আমাদের প্রত্যেককে আপনার বলিয়া গ্ৰহণ করিতে হইবে । যাহার টাকা আছে তিনি নিশ্চিন্ত হইয়া টাকা ভোগ করবেন না ; যাহার বুদ্ধি আছে তিনি কেবল অন্যের প্রয়াসকে বিচার করিয়া দিনযাপন করিবেন না ; দেশের কাজগুলিকে সফল করিবার জন্য যেখানেই আমাদের সকলের চেষ্টা মিলিত হইতে থাকিবে সেখানেই আমাদের স্বদেশ সত্য হইয়া উঠিবে। দেশ-জিনিসটা তো কাহাকেও নিজের শক্তিতে উপার্জন করিয়া আনিতে হয় নাই । আমরা যে পৃথিবীতে এত জায়গা থাকিতে এই বাংলাদেশেই জন্মিতেছি ও মরিতেছি। সে তো আমাদের নিজগুণে নহে, এবং বাংলাদেশেরও বিশেষ পুণ্যপ্রভাবে এমনও বলিতে পারি না। দেশ পশুপক্ষী-কীটপতঙ্গেরও আছে। কিন্তু স্বদেশকে নিজে সৃষ্টি করিতে হয়। সেইজন্যেই স্বদেশে কেহ হাত দিতে আসিলে স্বদেশীমাত্রেই উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠে ; কেননা, সেটা যে বহুকাল হইতে তাহদের নিজের গড়াসেখানে যে তাহদের বহু যুগের আহরিত মধু সমস্ত সঞ্চিত হইয়া আছে। যে-সকল দেশের লোক তাহাদের নিজের শরীর-মন-বাক্যের সমস্ত চেষ্টার দ্বারা জ্ঞানে প্রেমে কর্মে স্বদেশকে আপনি গড়িয়া