পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য ዔ Sዔ তুলিতেছে, দেশের অন্নবস্ত্রস্বাস্থ্যজ্ঞানের সমস্ত অভােব আপনি পূরণ করিয়া তুলিতেছে, দেশকে তাহারাই স্বদেশ বলিতে পারে এবং স্বদেশ-জিনিসটা যে কী তাহাদিগকে বক্তৃতা করিয়া বুঝাইতেও হয় না ; মৌমাছিকে আপনি চাকের মর্যাদা বুঝাইবার জন্য বড়ো বড়ো পুঁথির দােহাই পাড়া সম্পূর্ণ অনাবশ্যক। আমরা দেশের কোনো সত্যকর্মে নিজেরা হাত না লাগাইয়াও আজ পঁচিশ-ত্রিশ বৎসর ইংরেজি ও বাংলায়, গদ্যে ও পদ্যে, স্বদেশের গৌরব ঘোষণা করিয়া আসিতেছি। কিন্তু এই স্বদেশের স্বােটা যে কোথায় এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়া গোল্ডস্ট্রকর ম্যাক্সমুলার মুয়রের প্রত্নতত্ত্ব খুজিয়া হয়রান হইতে । হইয়াছে। শাণ্ডিল্যমুনির আশ্রমের জায়গািটার যদি আজ হঠাৎ আবিষ্কার হয় তবে আমি শাণ্ডিল্যাগোত্রের দোহাই দিয়া সেটা দখল করিতে গেলে আইনের পেয়াদা তো মানিবে না। পাঁচ-সাত হাজার বৎসর পূর্বের উপর স্বদেশের স্বকীয়ত্বের বরাত দিয়া গৌরব করিতে বসিলে কেবল গলা ভাঙাই সারা হয়। স্বকীয়ত্বকে অবিচ্ছিন্ন নিজের চেষ্টায় রক্ষা করিতে হয়। আজ আমাদের পক্ষে স্বদেশ কোথায় ? সমস্ত দেশের মধ্যে যেখানেই আমরা নিজের শক্তিতে দেশবাসীদের জন্য কিছু একটা গড়িয়া তুলিতে পারিয়াছি কেবলমাত্র সেইখনেই আমাদের স্বদেশ। এমনি করিয়া যাহা-কিছু গড়িয়া তুলিতে পারিব তাহাতেই আমাদের স্বদেশের বিস্তার ঘটিতে থাকিবে, সেই স্বদেশের উপর আমাদের সমস্ত প্ৰাণের দাবি জন্মিতে থাকিবে ; অন্যে যাহা দয়া করিয়া দিবে। তাহাতেও নহে এবং বহু হাজার বৎসর পূর্বে যে দলিল পাকা হইয়াছিল তাহাতেও না। আদ্যকার সভায় আমার নিবেদন এই সাহিত্যপরিষদের মধ্যে আপনারা সকলে মিলিয়া স্বদেশকে সত্য করিয়া তুলুন । বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলা এবং প্রত্যেক জেলার প্রত্যেক বাঙালি সাহিত্যপরিষদের মধ্যে নিজের ইচ্ছা ও চেষ্টাকে একত্রে জাগ্ৰত করিয়া আজ যাহা অস্ফুট আছে তাহা স্পষ্ট করুন, যাহা ক্ষুদ্র আছে তাহাকে মহৎ করুন। কোনখানে এই পরিষদের কী অসম্পূর্ণতা আছে তাহা লইয়া প্রশ্ন করবেন না, ইহাকে সম্পূৰ্ণ করিয়া তুলিয়া প্রত্যেকে গীেরবলাভ করুন। দেবপ্রতিমা ঘরে আসিয়া পড়িলে গৃহস্থকে তাহার পূজা সারিতেই হয় ; আজ বাঙালির ঘরে তিনটি দেবপ্রতিমা আসিয়াছে- সাহিত্যপরিষৎ, শিক্ষাপরিষৎ ও শিল্পবিদ্যালয় । ইহাদিগকে ফিরাইয়া দিলে দেশে যে অমঙ্গল ঘটিবে তাহার ভার আমরা বহন করিতে পারিব না । অনেকের মনে এ প্রশ্ন উঠিবে, দেশের কাজ হিসাবে সাহিত্যপরিষদের কাজটা এমনি কী একটা মস্ত ব্যাপার ! এইরূপ প্রশ্ন আমাদের দেশের একটা বিষম বিপদ। যুরোপ-আমেরিকা তাহার প্রকাণ্ড কর্মশালা লইয়া আমাদের চোখের সামনে আসিয়া দাড়াইয়াছে, তাই দেখিয়া আমাদের অবস্থা বড়ো হইবার পূর্বেই আমাদের নজর বড়ো হইয়া উঠিয়াছে। যে কাজ দেখিতে ছােটাে তাহাতে উৎসােহই হয় না ; এইজন্য বীজরোপণ করা হইল না, একেবারে আস্ত বনস্পতি তুলিয়া আনিয়া পুঁতিয়া অন্য দেশের অরণ্যের সঙ্গে প্ৰতিযোগিতা করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। এ তো প্রেমের লক্ষণ নহে, এ অহংকারের লক্ষণ । প্রেমের অসীম ধৈৰ্য, কিন্তু অহংকার অত্যন্ত ব্যস্ত । আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, ইংরেজ নানামতে আমাদিগকে অবজ্ঞা দেখাইয়া আমাদের অহংকারকে অত্যন্ত রাঙা করিয়া তুলিয়াছে। আমাদের এই কথাই কেবল বলিবার প্রবৃত্তি হইতেছে, আমরা কিছুতেই কম নই। এইজন্য । আমরা যাহা-কিছু করি সেটাকে খুবই বড়ো করিয়া দেখাইতে না পারিলে আমাদের বুক ফাটিয়া যায়। একটা কাজ ফান্দিবার প্রথমেই তো একটা খুব মস্ত নামকরণ হয় ; নামের সঙ্গে ‘ন্যাশনাল’ শব্দটা কিংবা ঐরকমের একটা বিদেশী বিড়ম্বন জুড়িয়া দেওয়া যায়। এই নামকরণ-অনুষ্ঠানেই গোড়ায় ভারি একটি পরিতৃপ্তি বােধ হয়। তার পরে বড়ো নামটি দিলেই বড়ো আয়তন না দিলে চলে না ; নতুবা বড়ো নাম ক্ষুদ্র আকৃতিকে কেবলই বিদ্রুপ করিতে থাকে। তখন নিজের সাধকে লঙ্ঘন করিতে চাই। তক্ৰমওয়াল লাগমের খাতিরে ওয়েলারের জুড়ি না হইলে মুখরক্ষা হয় না— এ দিকে “অদ্যভক্ষ্যোধনুৰ্গুণঃ’ । যেমন করিয়া হউক, একটা প্রকাণ্ড ঠাট গড়িয়া তুলিতে হয় ; ছােটােকে ক্রমে ক্ৰমে বড়ো করিয়া তুলিবার, কঁচাকে দিনে দিনে পাকা করিয়া তুলিবার যে স্বাভাবিক প্রণালী তাহা বিসর্জন দিয়া যত বড়ো প্ৰকাণ্ড স্পর্ধা খাড়া করিয়া তুলি তত বড়োই প্ৰকাণ্ড ব্যর্থতার আয়োজন করা