পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ8օ রবীন্দ্র-রচনাবলী প্ৰলয়কে পাঠিয়েছিলেন মোহের আবরণ উড়িয়ে দেবার জন্যে । তিনি জীৰ্ণতার আড়াল সরিয়ে দিয়ে আপনাকে প্রকাশ করলেন। ঝড় থামল। বললুম, অভ্যস্ত কর্ম নিয়ে এই-যে এতদিন কাটালুম, এতে তো চিত্ত প্ৰসন্ন হল না। যে আশ্রয় জীৰ্ণ হয়ে যায় তাকেও নিজের হাতে ভাঙতে মমতায় বাধা দেয় । ঝড় এসে আমার মনের ভিতরে তার ভিৎকে নাড়া দিয়ে গেল ; আমি বেরিয়ে আসতে হবে । বুঝলুম, বে। -শান্তিনিকেতন পত্র বৈশাখ’ কবিতা সম্বন্ধে অধ্যাপক চারুচন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন- "。 এক জাতের কবিতা আছে যা লেখা হয় বাইরের দরজা বন্ধ করে। সেগুলো হয়তো অতীতের স্মৃতি বা অনাগতের প্রত্যাশা, বাসনার অতৃপ্তি বা আকাঙক্ষার আবেগ, কিম্বা রূপরচনার আগ্রহের উপর প্রতিষ্ঠিত । আবার এক জাতের কবিতা আছে যা মুক্তদ্বার অন্তরের সামগ্ৰী, বাইরের সমস্ত-কিছুকে আপনার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে। তুমি আমার বৈশাখ" কবিতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছি। বলা বাহুল্য এটা শেষ-জাতীয় কবিতা । এর সঙ্গে জড়িত আছে। রচনাকালের সমস্ত-কিছু। -- বৈশাখী কবিতার মধ্যে মিশিয়ে আছে শান্তিনিকেতনের রুদ্রমধ্যাহ্নের দীপ্তি। যেদিন লিখেছিলুম সেদিন চারি দিক থেকে বৈশাখের যে তপ্তরূপ আমার মনকে আবিষ্ট করেছিল সেইটেই ওই কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে। সেই দিনটিকে যদি ভূমিকা-রূপে ওই কবিতার সঙ্গে তোমাদের চােখের সামনে ধরতে পারতুম তা হলে কোনাে প্রশ্ন তোমাদের মনে উঠত না। তোমার. প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে নীচের দুটি লাইন নিয়ে— ছায়ামূর্তি যত অনুচর দগ্ধতাম্র দিগন্তের কোন ছিদ্র হতে ছুটে আসে ! খোলা জানালায় বসে। ওই ছায়ামূর্তি অনুচরদের স্বচক্ষে দেখেছি। শুষ্করিক্ত দিগন্ত-প্রসারিত মাঠের উপর দিয়ে প্রেতের মতো হু হু করে ছুটে আসছে ঘূর্ণনৃত্যে, ধুলোেবালি শুকনাে পাতা উড়িয়ে দিয়ে। পরবতী শ্লোকেই ভৈরবের অনুচর। এই প্ৰেতগুলোর বর্ণনা আরো স্পষ্ট করেছি, পড়ে দেখো । । |- তার পরে এক জায়গায় আছে— সকরুণ তব মন্ত্ৰ-সাথে মৰ্মভেদী যত দুঃখ বিস্তারিয়া যাক বিশ্ব-পরে। এই দুটাে লাইনেরও ব্যাখ্যা চেয়েছ। সেদিনকার বৈশাখ-মধ্যাহ্নের সকরুণতা আমার মনে বেজেছিল বলেই ওটা লিখতে পেরেছি। ধুধু করছে মাঠ, ধাঝা করছে রোদদুর-কাছে আমলকী গাছগুলোর পাতা ঝিলমিল করছে, ঝাউ উঠছে নিশ্বসিত হয়ে, ঘুঘু ডাকছে স্নিগ্ধ সুরে—গাছের মর্মর, পাখিদের কাকলি, দূর আকাশে চিলের ডাক, রাঙা মাটির ছায়াশূন্য রাস্তা দিয়ে মন্থরগমন ক্লান্ত গোরুর গাড়ির চাকার আর্তম্বর, সমস্তটা জড়িয়ে মিলিয়ে যে একটি বিশ্বব্যাপী করুণার সুর উঠতে থাকে, নিঃসঙ্গ বাতায়নে বসে সেটি শুনেছি, অনুভব করেছি, আর তাই লিখেছি। বৈশাখের অনুচরীর যে ছায়ানুত্য দেখি সেটা অদৃশ্য নয় তো কী ? নৃত্যের ভঙ্গী দেখি, ভাব দেখি, কিন্তু নটী কোথায় ? কেবল একটা আভাস মাঠের উপর দিয়ে ঘুরে যায়। তুমি বলছি, তুমি । তার ধ্বনি শুনেছ। কিন্তু যে দিগন্তে আমি তার ঘূর্ণিগতিটাকে দেখেছি সেখান থেকে কোনো শব্দই পাইনি। বৃহৎ ভূমিকার মধ্যে তরুরিক্ত বিশাল প্রান্তরে যে চঞ্চল আবির্ভাব ধূসর আবর্তনে দেখা যায় তার রূপ নয় তার গতিই অনুভব করি, তার শব্দ তো শুনিই নে। এ স্থলে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরে যাবার জো নেই। |- —পত্র । ৪ কার্তিক ১৩৩৯