পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্ৰন্থপরিচয় १६७ কোনো উত্তর দেন নিশ্চয়ই সেটা ভুল উত্তর হবে। আমি যদি ব্ৰাহ্মণসভার সভ্য হই। তবে আমি ঠিক করব, কবির উদ্দেশ্য বৰ্ণভেদ বাঁচিয়ে চলা সম্বন্ধে জগৎকে সদুপদেশ দেওয়া। যদি স্বাধীন জেনেনার বিরুদ্ধপক্ষ হই তা হলে বলব, পরপুরুষের মুখদর্শন পরিহার করতে বলাই কবির পরামর্শ। । কিংবা কবির বুদ্ধি বা ধৰ্মজ্ঞানের প্রতি যদি আমার সন্দেহ থাকে তা হলে বলব, একনিষ্ঠ পাতিব্ৰত্যের নিদারুণ পরিণামদেখিয়ে তিনি সতীত্বের মূলে কুঠারাঘাত করেছেন, কিংবা ইয়াগাের চাতুরীকেই শেষ পর্যন্ত জয়ী করে তুলে সরলতার প্রতি নিষ্ঠুর বিদ্রুপ প্রকাশ করাই তার মতলব । কিন্তু সােজা কথা হচ্ছে, তিনি নাটক লিখেছেন। সেই নাটকে কবির ভালো-লাগা মন্দা-লাগা, এমনকি, কবির দেশ-কালও প্রকাশ পায়, কিন্তু সেটা তত্ত্ব বা উপদেশ-রূপে নয়, শিল্পীরূপেই। অর্থাৎ সমস্ত নাটকের অবিচ্ছিন্ন প্রাণ এবং লাবণ্যরূপে। যেমন একজন বাঙালিকে যখন দেখি তখন মানুষটার সঙ্গে তার জাতিকে তার বাপ-দাদাকে সম্মিলিত করে দেখি, তার ব্যক্তি এবং তার জাতি দুইয়ের মাঝখানে কোনাে জোড়ের চিহ্ন থাকে না ; এও তেমনি। কবির কাব্যে । স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে আর তার দেশকালের সঙ্গে একটা প্ৰাণগত সম্মিলন আছে। তাই বলছিলুম, ঘরে-বাইরে গল্প যখন লেখা যাচ্ছে তখন তার সঙ্গে সঙ্গে লেখকের সাময়িক অভিজ্ঞতা জড়িত হয়ে পড়েছে এবং লেখকের ভালোমন্দ লাগাটাও বোনা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেই রঙিন সুতোগুলো শিল্পেরই উপকরণ । তাকে যদি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা যায়। তবে সে উদ্দেশ্য লেখকের নয়, পাঠকের । শৌখিন লোকে চমরীর পুচ্ছ থেকে চামর তৈরি করে ; কিন্তু চমরী জানে তার পুচ্ছটা তার প্রাণের অন্তৰ্গত, ওটাকে কেটে নিয়ে চামর করা অন্তত তার উদ্দেশ্য নয়- যে করে তারই । os V তার পরে কথা হচ্ছে, আমার হৃদয়ভাবের সঙ্গে পাঠকের হৃদয়ভাবের যখন বিরোধ ঘটল তখন পাঠক আমাকে দণ্ড দিতে বাধ্য। মাটির উপর পড়ে গেলে শিশু যেমন মাটিকে মারে তেমনি এমন স্থলে সাধারণ পাঠকে দণ্ড দিয়ে থাকে, এ কথা আমার বিশেষরূপ জানা । তাই বলে দণ্ড যে দিতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। ভূতকে না ভয় করতে পারি, এমন-কি, ভূতের ভয় অনিষ্টকর মনে করতেও পারি, তবু ভূতের ভূয়ের গল্প পড়বার সময়ে সে কথা মনে রাখবার দরকার নেই। এখানে মতামতের কথা নয়, রসের অনুভূতির কথা। খৃস্টান রসিক যখন কোনো হিন্দু আটিস্টের আঁকা দেবীমূর্তির বিচার করেন তখন যদি তিনি ভুলতে পারেন যে তিনি মিশনারি তা হলেই ভালো, যদি না পারেন তবে সেজন্যে হিন্দু আর্টিস্টকে দােষ দেওয়া চলবে না। কারণ, হিন্দু আর্টিস্ট স্বভাবতই আপন মত বিশ্বাস সংস্কার -অনুসারে ছবি আঁকবেই; কিন্তু যেহেতু সেটা ছবি সেইজন্যেই তার মধ্যে মত বিশ্বাস সংস্কারের অতীত একটি জিনিস থাকবে, সেটি হচ্ছে রস ; সে রস যদি অহিন্দুর অগ্রাহ্য হয় তবে, হয় রসবোধের অভাবে সেটা অহিন্দুর দোষ, নয় রসের অভাবে সেটা হিন্দু আটিস্টের দোষ । কিন্তু দোষটা মত-বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে না । প্ৰদীপ ইংরেজের একরকম এবং উটুজলন্ঠন চলতি হবার পূর্বে হিন্দুর অন্যরকম ছিল, তবু আলো জিনিসটা আলোই। দেশের হিতাহিত সম্বন্ধে আমার সঙ্গে পাঠকের মতভেদ থাকা সম্ভব ; কিন্তু গল্পকে মত বলে দেখবার তো দরকার নেই, গল্প বলেই দেখতে হবে। . 8]]8Եr