পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী صebج আমার নীরস তপ্ত ধূলির উপরে পড়িয়া মিলাইতেছিল। আবার তাহার পরদিন অপরাgে বালিকা সেইখানে সেই তরুতলে আসিয়া দাড়াইল, কিন্তু সেদিনও আর একজন আসিল না। আবার রাত্রে সে ধীরে ধীরে বাড়িমুখে ফিরিল। কিছুদূরে গিয়া আর সে চলিতে পারিল না। আমার উপরে ধূলির উপরে লুটাইয়া পড়িল । দুই বাহুতে মুখ ঢাকিয়া বুক ফাটিয়া কাদিতে লাগিল। কে গো মা, আজি এই বিজন রাত্রে আমার বক্ষেও কি কেহ আশ্রয় লইতে আসে। তুই যাহার কাছ হইতে ফিরিয়া আসিলি সে কি আমার চেয়েও কঠিন । তুই যাহাকে ভাকিয়া সাড়া পাইলি না সে কি আমার চেয়েও মুক । তুই যাহার মুখের পানে চাহিলি সে কি আমার চেয়েও অন্ধ। । বালিকা উঠিল, দাড়াইল, চোখ মুছিল—পথ ছাড়িয়া পার্শ্ববর্তী বনের মধ্যে চলিয়া গেল। হয়তো সে গৃহে ফিরিয়া গেল, হয়তো এখনও সে প্রতিদিন শাস্তমুখে গৃহের কাজ করে—হয়তো সে কাহাকেও কোনো দুঃখের কথা বলে না ; কেবল এক-একদিন সন্ধ্যাবেলায় গৃহের অঙ্গনে চাদের আলোতে পা ছড়াইয়া বসিয়া থাকে, কেহ ডাকিলেই আবার তখনই চমকিয়া উঠিয়া ঘরে চলিয়া যায়। কিন্তু তাহার পরদিন হইতে আজ পর্যন্তও আমি আর তাহার চরণস্পর্শ অনুভব করি নাই । এমন কত পদশব্দ নীরব হইয়া গেছে, আমি কি এত মনে করিয়া রাখিতে পারি। কেবল সেই পায়ের করুণ নৃপুরধ্বনি এখনও মাঝে মাঝে মনে পড়ে। কিন্তু আমার কি আর একদণ্ড শোক করিবার অবসর অাছে । শোক কাহার জন্য করিব। এমন কত আসে, কত যায় । কী প্রখর রৌদ্র। উহু-হুহু। এক-একবার নিশ্বাস ফেলিতেছি আর তপ্ত ধুলা স্বনীল আকাশ ধূসর করিয়া উড়িয়া ঘাইতেছে। ধনী দরিত্র, স্বর্থী দুঃখী, জরা যৌবন, হাসি কান্না, জন্ম মৃত্যু সমস্তই আমার উপর দিয়া একই নিশ্বাসে ধূলির স্রোতের মতো উড়িয়া চলিয়াছে। এই জন্য পথের হাসিও নাই, কান্নাও নাই। গৃহই অতীতের জন্য শোক করে, বর্তমানের জন্ত ভাবে, ভবিষ্যতের আশা-পথ চাহিয়া থাকে । কিন্তু পথ প্রতি বর্তমান নিমেষের শতসহস্ৰ নৃতন অভ্যাগতকে লইয়াই ব্যস্ত। এমন স্থানে নিজের পদগৌরবের প্রতি বিশ্বাস করিয়া অত্যন্ত সদৰ্পে পদক্ষেপ করিয়া কে নিজের চির-চরণচিহ্ন রাখিয়া যাইতে প্রয়াস পাইতেছে । এখানকার বাতাসে যে দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া যাইতেহু, তুমি চলিয়া গেলে কি তাহারা তোমার পশ্চাতে পড়িয় তোমার জগু বিলাপ করিতে থাকিবে, নৃতন অতিথিদের চক্ষে অশ্রু অাকর্ষণ করিয়া জানিবে ? বাতাসের উপরে বাতাস কি স্থায়ী হয়। না না, বৃথা চেষ্টা। আমি কিছুই পড়িয়া থাকিতে দিই না, হাসিও না, কান্নাও না । আমিই কেবল পড়িয়া আছি । অগ্রহায়ণ, ১২৯১ : ի