পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ԳՀ রবীন্দ্র-রচনাবলী গিরিতট দেখে বলে উঠেছিলেন, যত্র ক্রমা অপি মুগা অপি বন্ধবো মে। তাই সাঁতাবিচ্ছেদকালে তিনি তাদের পূর্বনিবাসভূমি দেখে আক্ষেপ করেছিলেন যে, মৈথিলী তার করকমলবিকীর্ণ জল নীবার ও তৃণ দিয়ে যে-সকল গাছ পাখি ও হরিণদের পালন করেছিলেন তাদের দেখে আমার হৃদয় পাষাণগলার মতো গলে যাচ্ছে । মেঘদূতে যক্ষের বিরহ নিজের দুঃখের টানে স্বতন্ত্র হয়ে একলা কোণে বসে বিলাপ করছে না। বিরহ-দুঃখই তার চিত্তকে নববর্ষায় প্রফুল্ল পৃথিবীর সমস্ত নগনদী-অরণ্যনগরীর মধ্যে পরিব্যাপ্ত করে দিয়েছে । মামুষের হৃদয়বেদনাকে কবি ংকীর্ণ করে দেখান নি, তাকে বিরাটের মধ্যে বিস্তীর্ণ করেছেন ; এই জন্যই প্রভূশাপগ্ৰস্ত একজন ধক্ষের দুঃখবার্তা চিরকালের মতো বৰ্ষাঋতুর মর্মস্থান অধিকার করে প্রণয়ী-হৃদয়ের খেয়ালকে বিশ্বসংগীতের ধ্রুপদে এমন করে বেঁধে দিয়েছে। ভারতবর্ষের এইটেই হচ্ছে বিশেষত্ব । তপস্যার ক্ষেত্রেও এই দেখি, যেখানে তার হৃদয়বৃত্তির লীলা সেখানেও এই দেখতে পাই । মানুষ দুই রকম করে নিজের মহত্ব উপলব্ধি করে—এক, স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে, আরএক মিলনের মধ্যে । এক, ভোগের দ্বারা, আর-এক যোগের দ্বারা । ভারতবর্ষ স্বভাবতই শেষের পথ অবলম্বন করেছে। এইজন্তেই দেখতে পাই যেখানেই প্রকৃতির মধ্যে কোনো বিশেষ সৌন্দর্য বা মহিমার আবির্ভাব সেইখানেই ভারতবর্ষের তীর্থস্থান । মানবচিত্তের সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির মিলন যেখানে স্বভাবতই ঘটতে পারে সেই স্থানটিকেই ভারতবর্ষ পবিত্র তীর্থ বলে জেনেছে। এ সকল জায়গায় মানুষের প্রয়োজনের কোনো উপকরণই নেই, এখানে চাষও চলে না বাসও চলে না, এখানে পণ্যসামগ্রীর আয়োজন নেই, এখানে রাজার রাজধানী নয়,—অন্তত সেই সমস্তই এখানে মুখ্য নয়। এখানে নিখিল প্রকৃতির সঙ্গে মানুষ আপনার যোগ উপলব্ধি করে আত্মাকে সর্বগ ও বৃহং বলে জানে। এখানে প্রকৃতিকে নিজের প্রয়োজন সাধনের ক্ষেত্র বলে মানুষ জানে না, তাকে আত্মার উপলব্ধি সাধনের ক্ষেত্র বলেই মানুষ অনুভব করে, এইজন্যেই তা পুণ্যস্থান । нтъ ভারতবর্ষের হিমালয় পবিত্র, ভারতবর্ষের বিন্ধ্যাচল পবিত্র, ভারতবর্ষের যে নদীগুলি লোকালয়সকলকে অক্ষয়ধারায় স্তম্ভ দান করে আসছে তারা সকলেই পুণ্যসলিলা । হরিদ্বার পবিত্র, হৃষীকেশ পবিত্র, কেদারনাথ বদরিকাশ্ৰম পবিত্র, কৈলাস পবিত্র, মানস সরোবর পবিত্র, গঙ্গার মধ্যে যমুনার মিলন পবিত্র, সমুদ্রের মধ্যে গঙ্গার অবসান পবিত্র। যে বিরাট প্রকৃতির দ্বারা মানুষ পরিবেষ্টিত, যার আলোক এসে তার চক্ষুকে সার্থক করেছে, যার উত্তাপ তার সর্বাঙ্গে প্রাণকে স্পদিত করে তুলছে,