পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ se কহিলেন, “আমার এ বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।” গদাধরবাবু কহিলেন, “এখন কথা হচ্ছে যে, স্ত্রীলোকদের কষ্টমোচনে আমরা যদি দৃষ্টান্ত না দেখাই তবে কে দেখাইবে । এসো, আজ থেকেই এ বিষয়ের চেষ্টা করা যাক ৷” নরেন্দ্রের তাহাতে কোনো আপত্তি ছিল না । তিনি মনে-মনে কেবল ভাবিতে লাগিলেন, এখন কাহার অন্তঃপুরের প্রাচীর ভাঙিতে হইবে। গদাধরবাবু কহিলেন, “স্মরণ থাকতে পারে মোহিনী নামে এক বিধবার কথা সেদিন বলেছিলুম, আমাদের প্রথম পরীক্ষা তাহার উপর দিয়াই চলুক। এ বিষয়ে যা-কিছু বাধা আছে তা আলোচনা করে দেখা যাক। যেমন এক একটা পোষা পাখি শৃঙ্খলমুক্ত হলেও স্বাধীনতা পেতে চায় না, তেমনি সেই বিধবাটিও স্বাধীনতার সহস্র উপায় থাকিতেও অন্তঃপুরের কারাগার হইতে মুক্ত হইতে চায় না। সুতরাং আমাদের প্রথম কর্তব্য তাহাকে স্বাধীনতার সুমিষ্ট আস্বাদ জানাইয়া দেওয়া ।” নরেন্দ্ৰ কহিলেন সকল দিক ভাবিয়া দেখিলে এ বিষয়ে কাহারও কোনোপ্রকার আপত্তি থাকিতে পারে না। সে বিধবার ভরণপোষণ বাসস্থান ইত্যাদি সমুদয় বন্দোবস্তের ভার নরেন্দ্ৰ নিজ স্কন্ধে লইতে স্বীকৃত হইলেন। ক্রমে ত্রিভঙ্গচন্দ্র বিশ্বম্ভর ও জন্মেজয়বাবু আসিলেন, ক্রমে সন্ধাও হইল, প্লেট আসিল, বোতল আসিল । গদাধরবাবু স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে অনেক বক্তৃতা দিয়া ও স্বরূপবাবু জ্যোৎস্না-রাত্রির বিষয়ে নানাবিধ কবিতাময় উদাহরণ প্রয়ােগ করিয়া শুইয়া পড়িলেন, ত্রিভঙ্গচন্দ্র ও বিশ্বম্ভরবাবু স্থলিত স্বরে গান জুড়িয়া দিলেন, নরেন্দ্র ও জন্মেজয় কাহাকে যে গালাগালি দিতে লাগিলেন বুঝা গেল না। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ भाश्य মহেন্দ্র এতদিন বেশ ভালো ছিল। ইস্কুলে ছাত্রবৃত্তি পাইয়াছে, কলেজে এলে, বি. এ. পাস করিয়াছে, মেডিকাল কলেজে তিন চার বৎসর পড়িয়াছে, আর কিছুদিন পড়িলেই পাস হইত— কিন্তু বিবাহ হওয়ার পর হইতেই অমন হইয়া গৈল কেন। আমাদের সঙ্গে আর দেখা করিতে আসে না, আমরা গেলে ভালো করিয়া কথা কয় না- এ-সব তো ভালো লক্ষণ নয় । সহসা এরূপ পরিবর্তন যে কেন হইল। আমরা ভিতরে ভিতরে তাহার সন্ধান লইয়াছি। মূল কথাটা এই কন্যাকর্তাদিগের নিকট হইতে অর্থ লইয়া মহেন্দ্রের পিতা যে কন্যার সহিত পুত্রের বিবাহ দেন তাহা মহেন্দ্রের বড়ো মনোনীত হয় নাই। মনোনীত না হইবারই কথা বটে। তাহার নাম রজনী ছিল, বৰ্ণও রজনীর ন্যায় অন্ধকার ; তাহার গঠনও যে কিছু উৎকৃষ্ট ছিল তােহা নয় ; কিন্তু মুখ দেখিলে তাহাকে অতিশয় ভালো মানুষ বলিয়া বোধ হয় । বেচারি কখনো কাহারও কাছে আদর পায় নাই, পিত্ৰালয়ে অতিশয় উপেক্ষিত হইয়াছিল। বিশেষত তাহার রূপের দোষে বর পাওয়া যাইতেছে না বলিয়া যাহার তাহার কাছে তাহাকে নিগ্ৰহ সহিতে হইত। কখনো কাহারও সহিত মুখ তুলিয়া কথা কহিতে সাহস করে নাই। একদিন আয়না খুলিয়া কপালে টিপ পরিতেছিল বলিয়া কত লোকে কত রকম ঠাট্টা বিদ্রুপ করিয়াছিল; সেই অবধি উপহাসের ভয়ে বেচারি কখনাে আয়নাও খুলে নাই, কখনাে বেশভুষাও করে নাই। স্বামী-আলয়ে আসিল । সেখানে স্বামীর নিকট হইতে এক মুহুর্তের নিমিত্তও আদর পাইল না, বিবাহরাত্রের পরদিন হইতে মহেন্দ্ৰ তাহার কাছে শুইত না । এ দিকে মহেন্দ্র এমন বিদ্বান, এমন মৃদুস্বভাব, এমন সব্দবন্ধু ছিল, এমন আমােদদায়ক সহচর ছিল, এমন সহৃদয় লোক ছিল যে, সেও সকলকে ভালোবাসিত, তাহাকেও সকলে ভালোবাসিত । রজনীর কপালদোষে সে মহেন্দ্রও বিগড়াইয়া গৈল । মহেন্দ্ৰ পিতাকে কখনো অভক্তি করে নাই, কিন্তু বিবাহের পরদিনেই পিতাকে যাহা বলিবার নয় যে অবাধ্য হইয়া যাইবে ইহা তো কথাই আছে।