পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

de Ve রবীন্দ্র-রচনাবলী চতুর্থ পরিচ্ছেদ । পণ্ডিতমহাশয়ের দ্বিতীয় পক্ষের বিবাহ পূর্বে রঘুনাথ সার্বভৌম মহাশয়ের একটি টােল ছিল। অর্থাভাবে অল্প দিনেই টােলটি উঠিয়া যায়। গ্রামের বর্ধিষ্ণু জমিদার অনুপকুমার যে পাঠশালা স্থাপন করেন, অল্প বেতনে তিনি তাহার গুরুমহাশয়ের পদে নিযুক্ত হন। কিন্তু গুরুমহাশয়ের পদে আসীন হইয়া তাহার শান্তপ্রকৃতির কিছুমাত্র व्क शं नो | - পণ্ডিতমহাশয় বলিতেন, তাহার বয়স সবে চল্লিশ বৎসর । এই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া শপথ করিয়া বলা যায় তাহার বয়স আটচল্লিশ বৎসরের নতুন নয়। সাধারণ পণ্ডিতদের সহিত র্তাহার আর কোনো বিষয় মিল ছিল না- তিনি খুব টসটসে রসিক পুরুষ ছিলেন না বা খটখটি ঘট-পট-বাগীশ ছিলেন না, দলাদলির চক্রান্ত করিতেন না, শাস্ত্রের বিচার লইয়া বিবাদে লিপ্ত থাকিতেন না, বিদায়-আদায়ের কোনো আশাই রাখিতেন না । কেবল মিল ছিল প্রশস্ত উদরটিতে, নিস্যের ডিবাটিতে, ক্ষুদ্র টিকিটিতে ও শ্মশ্রুবিহীন মুখে । পাঠশালার বালকেরা প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা তাহার বাড়িতেই পড়িয়া থাকিত । এই বালকদের জন্য র্তাহার অনেক সন্দেশ খরচ হইত ; সন্দেশের লোভ বড়োই ভালোমানুষ ছিলেন এবং দুষ্ট বালকেরা তাহার উপর বড়োই অত্যাচার করিত। পণ্ডিতমহাশয়ের নিদ্রাটি এমন অভ্যস্ত ছিল যে, তিনি শুইলেই ঘুমাইতেন, বসিলেই ঢুলিতেন ও দাড়াইলেই হই তুলিতেন। এই সুবিধা পাইয়া বালকেরা তাহার নিস্যেরা ডিবা, চটজুতা ও চশমার ঠুঙিটি চুরি করিয়া লইত। এর্কে তো পৃণ্ডিতমহাশয় অতিশয় আলগা লোক, তাহাতে পাঠশালার দুষ্ট বালকেরা তাহার বাটীতে কিছুমাত্র শৃঙ্খলা রাখিত না । পাঠশালায় যাইবার সময় কোনোমতে র্তাহার চটিজুতা খুঁজিয়া পাইতেন না, অবশেষে শূন্যপদেই যাইতেন। একদিন সকালে উঠিয়া দৈবাৎ দেখিতে পাইলেন তাহার শয়নগৃহে বোলতায় চাক করিয়াছে, ভয়ে বিব্রত হইয়া সে ঘরই পরিত্যাগ করিলেন ; সে ঘরে তিন পরিবার বোলতায় তিনটি চাক বঁধিল, ইদুরে গর্ত করিল, মাকড়সা প্রাসাদ নির্মাণ করিল। এবং লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র পিপীলিকা সার বাধিয়া গৃহময় রাজপথ বসাইয়া দিল। বালীর পক্ষে ঋষ্যমুখ পর্বত যেরূপ, পণ্ডিতমহাশয়ের পক্ষে এই ঘরটি সেরূপ হইয়া পড়িয়াছিল। পাঠশালায় গমনে অনিচ্ছুক কোনাে বালক যদি সেই গৃহে লুকাইত। তবে আর পণ্ডিতমহাশয় তাহাকে ধরিতে পারিতেন না। গৃহের এইরূপ আলগা অবস্থা দেখিয়া পণ্ডিতমহাশয় অনেকদিন হইতে . একটি গৃহিণীর চিন্তায় আছেন। পূর্বকার গৃহিণীটি বড়ো প্রচণ্ড স্ত্রীলোক ছিলেন। নিরীহপ্রকৃতি সার্বভৌম মহাশয় দিল্লীশ্বরের ন্যায় তাহার আজ্ঞা পালন করিতেন। স্ত্রী নিকটে থাকিলে অন্য স্ত্রীলোক দেখিয়া চক্ষু মুদিয়া, থাকিতেন । একবার একটি অষ্টমবর্ষীয়া বালিকার দিকে চাহিয়াছিলেন বলিয়া তাহার পত্নী সেই বালিকাটির মৃত পিতৃপিতামহ প্রপিতামহের নামোল্লেখ করিয়া যথেষ্ট গালি বর্ষণ করেন ও সার্বভৌম মহাশয়ের মুখের নিকট হাত নাড়িয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, “তুমি মরো, তুমি মরো, তুমি মরো ? পণ্ডিতমহাশয় মরণকে বড়ো ভয় করিতেন, মরণের কথা শুনিয়া তাহার বুক ধড়াস। ধড়াসা করিতে व्लळ्नि | স্ত্রীর মৃত্যুর পর দৈনিক গালি না পাইয়া অভ্যাসদোষে দিনকতক বড়ো কষ্ট অনুভব করিতেন। যাহা হউক, অনেক কারণে পণ্ডিতমহাশয় বিবাহের চেষ্টায় আছেন । পণ্ডিতমহাশয়ের একটা কেমন অভ্যাস ছিল যে, তিনি সহস্ৰমিষ্টারের লোভ পাইলেও কাহারও বিবাহসভায় উপস্থিত থাকিতেন না । কাহারও বিবাহের সংবাদ শুনিলে সমস্ত দিন মন খারাপ হইয়া থাকিত । পণ্ডিতমহাশয়ের এক ভট্টাচাৰ্যবন্ধু ছিলেন ; তাহার মনে ধারণা ছিল যে তিনি বড়েই রসিক, যে ব্যক্তি র্তাহার কথা শুনিয়া না হাসিত তাহার উপরে তিনি আন্তরিক চটিয়া যাইতেন । এই রসিক বন্ধু মাঝে মাঝে আসিয়া ভট্টাচার্যায় ভঙ্গি ও স্বরে সার্বভৌম মহাশয়কে কহিতেন, “ওহে ভায়া, শাস্ত্ৰে আছে