পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

obr রবীন্দ্র-রচনাবলী কন্যাকর্তারা জানিয়া গেল যে, নিধি কাজ কর্ম করে, লেখাপড়াও জানে। তাহার পরদিনেই বিবাহ হইয়া গেল। নিধি ইহার মধ্যে একটি কথা চাপিয়া যায়, আমরা সেটি সন্ধান পাইয়াছি-পাড়ার একটি এনট্রেন্স ক্লাসের ছাত্র তাহাকে বলিয়া দিয়াছিল যে, “যদি তোমাকে জিজ্ঞাসা করে কোন কলেজে পড়, তবে বলিয়াে বিশপস কলেজে ।” দৈবক্রমে বিবাহসভায় ঐ প্রশ্ন করায় নিধি গভীরভাবে উত্তর দিয়াছিল বিষাক্ত কলেজে । ভাগ্যে কন্যাকর্তারা নিধির মুখতাকে রসিকতা মনে করে তাই সে যাত্রায় সে মানে মানে রক্ষা পায় । নিধি আসিয়াই মহা গোলযোগ বাধাইয়া দিলেন । ‘ওরে ও”— ‘ওরে তা- এ ঘরে একবার, ও ঘরে একবার- এটা ওলটাইয়া, ওটা পালটাইয়া- দুই-একটা বাসন ভাঙিয়া, দুই-একটা পুঁথি ছিড়িয়া- পাড়া-সুদ্ধ তোলপাড় করিয়া তুলিলেন । কোনো কাজই করিতেছেন না। অথচ মহা গোল মহা ব্যস্ত। চটজুতা চট্ট চট্ট করিয়া এ ঘর ও ঘর, এ বাড়ি ও বাড়ি, এ পাড়া ও পাড়া করিতেছেন— । কোনোখানেই দাড়াইতেছেন না, উর্ধ্বশ্বাসে ইহাকে দু-একটি উহাকে দুই-একটি কথা বলিয়া আবার সাটু সট করিয়া গুরুমহাশয়ের বাড়ি প্রবেশ করিতেছেন। ফলটা এই সন্ধ্যার সময় গিয়া দেখিবসার্বভৌম মহাশয়ের বাড়ি যে-কে-সেই, তবে পূর্বে এক দিনে যাহা পরিষ্কৃত হইত এখন এক সপ্তাহেও তাহা হইবে না। যাহা হউক, গৃহ পরিষ্কার করিতে গিয়া একটি গুরুতর ব্যাপার ঘটিয়াছিল— বঁটার আঘাতে, লোকজনের কোলাহলে, তিন-ঘর বোলতা বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। নিধিরামের নাক মুখ ফুলিয়া উঠিল— চটি জুতা ফেলিয়া, টিকি উড়াইয়া, কেঁচার কাপড়ে পা জড়াইতে জড়াইতে, চৌকাটে ইচুটি খাইতে খাইতে, পণ্ডিতমশায়কে গালি দিতে দিতে গৃহ পরিত্যাগ করিলেন। এক সপ্তাহ ধরিয়া বাড়ির ঘরে ঘরে বিশৃঙ্খল বোলতার দল উড়িয়া বেড়াইত। বেচারি পণ্ডিতমহাশয় দশ দিন আর অরিক্ষত গৃহে বোলতার ভয়ে প্রবেশ করেন নাই, প্রতিবাসীর বাটীতে আশ্রয় লইয়াছিলেন। পরে গৃহে ফিরিয়া আসিলেন ও যাইবার সময় ঘটী ঘড়া ইত্যাদি যে-সকল দ্রব্য বাড়িতে দেখিয়া গিয়াছিলেন, আসিবার সময় তাহা আর দেখিতে পাইলেন না । অদ্য বিবাহ হইবে। পণ্ডিতমহাশয় কাল সমস্ত রাত স্বপ্ন দেখিয়াছেন। বহুকালের পুরানো সেই বঁটাগাছটি স্বপ্নে দেখিতে পাইয়াছিলেন, এটি তাহার শুভ লক্ষণ বলিয়া মনে হইল। হাসিতে হাসিতে প্ৰত্যুষেই শয্যা হইতে গাত্ৰোখান করিয়াছেন । চেলীর জোড় পরিয়া চন্দনচর্চিত কলেবরে ভাবে ভোর হইয়া বসিয়া আছেন। থাকিয়া থাকিয়া সহসা পণ্ডিতমহাশয়ের মনে একটি দূর্ভাবনার উদয় হইল। তিনি ভাবিলেন, সকলই তো হইল, এখন নীেকায় উঠিবেন কী করিয়া । অনেকক্ষণ ধরিয়া ভাবিতে লাগিলেন ; বিশ-বাইশ ছিলিম তাম্রকুট ভস্ম হইলে ও দুই-এক ডিবা নস্য ফুরাইয়া গেলে পর একটা সদুপায় নির্ধারিত হইল। তিনি ঠিক করিলেন যে নিধিরামকে সঙ্গে লইবেন । তাহার বিশ্বাস ছিল নিধিরাম সঙ্গে থাকিলে নৌকা ডুবিবার কোনো সম্ভাবনাই নাই। নিধির অন্বেষণে চলিলেন । সেদিনকার দুর্ঘটনার পরে নিধি ‘আর পণ্ডিতমহাশয়ের বাড়িমুখ হইব না বলিয়া স্থির করিয়াছিল, অনেক খোেশামোদে স্বীকৃত হইল। এইবার নীেকায় উঠতে হইবে। সার্বভৌমমহাশয় তীরে দাড়াইয়া নস্য লাইতে লাগিলেন । আমাদের নিধিরামও নীেকাকে বড়ো কম ভয় করিতেন না, যদি কন্যাকর্তাদের বাড়িতে আহারের প্রলোভন না থাকিত তাহা হইলে প্ৰাণান্তেও নীেকায় উঠিতেন না। অনেক কষ্টে পাঁচ-ছয়-জন মাঝিতে ধরাধরি করিয়া তাহাদিগকে কোনোক্রমে তো নীেকায় তুলিল। নীেকা ছাড়িয়া দিল। নীেকা যতই নড়েচড়ে পণ্ডিতমহাশয় ততই ছটফট করেন, পণ্ডিতমহাশয় যতই ছটফট করেন নীেকা ততই টলমল করে; মহা হাঙ্গাম, মাঝিরা বিব্রত,পণ্ডিতমহাশয় চীৎকার করিতে আরম্ভ করিলেন ও মাঝিদিগকে বিশেষ করিয়া অনুরোধ করিলেন যে, যদিই পাড়ি দিতে হইল। তবে যেন ধার-ধার দিয়া দেওয়া হয়। নিধিরামের মুখে কথাটি নাই। তিনি এমন অবস্থায় আছেন যে, একটু বাতাস উঠিলে বা একটু মেঘ দেখা দিলেই নীেকার মাস্তুলটা লইয়া জলে ঝাপাইয়া পড়িবেন । পণ্ডিতমহাশয় আকুল ভাবে নিধির মুখের দিকে চাহিয়া আছেন। দুই-এক জায়গায় তরঙ্গবেগে নীেকা একটু টলমল করিল, নিধি লাফাইয়া উঠিল, পণ্ডিতমহাশয় নিধিকে জড়াইয়া ধরিলেন। তখনো তাহার বিশ্বাস ছিল নিধিকে