পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

fe আশ্রয় করিয়া থাকিলে প্ৰাণহানির কোনো সম্ভাবনা নাই। নিধি সার্বভৌমমহাশয়ের বাহুপাশ ছাড়াইবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন, পণ্ডিতমহাশয় ততই প্ৰাণপণে আঁটিয়া ধরিতে লাগিলেন । শীর্ণকায় নিধি দারুণ নিষ্পেষণে রুদ্ধশ্বাস হইয়া যায় আর-কি, রোষে বিরক্তিতে যন্ত্রণায় চীৎকার করিতে লাগিল। এইরূপ গােলযোগ করিতে করিতে নীেক তীরে লাগিল। মাঝিরা এরূপ নীেকাযাত্রা আর কখনো দেখে নাই। তাহারা ইপি ছাড়িয়া বাচিল, কণ্ঠাগতপ্ৰাণ নিধি নিশ্বাস লইয়া বাচিলেন, পণ্ডিতমহাশয় এক ঘটি জল খাইয়া বঁচিলেন । বিবাহের সন্ধ্যা উপস্থিত। পণ্ডিতমহাশয় টিকিযুক্ত শিরে টােপর পরিয়া গাদির উপর বসিয়া আছেন। অনাহারে, নীেকার পরিশ্রমে ও অভ্যাসদোষে দারুণ ঢুলিতেছেন। মাথার উপর হইতে মাঝে মাঝে টোপর খসিয়া পড়িতেছে। পার্শ্ববর্তী নিধি মাঝে মাঝে এক-একটি গুতা মারিতেছে ; সে এমন ওঁতা যে তাহাতে মৃত ব্যক্তিরও চৈতন্য হয়, সেই গুতা খাইয়া পণ্ডিতমহাশয় আবার ধড়ফড়িয়া উঠিতেছেন ও শিরচ্যুত টােপরটি মাথায় পরিয়া মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে চারি দিক অবলোকন করিতেছেন, সভাময় চোখ-টেপাটেপি করিয়া হাসি চলিতেছে। লগ্ন উপস্থিত হইল, বিবাহের অনুষ্ঠান আরম্ভ হইল। পণ্ডিতমহাশয় দেখিলেন, পুরোহিতটি তাহারই টােল-আউট শিষ্য | শিষ্য মহা লজ্জায় পড়িয়া গেল। পণ্ডিতমহাশয় কানে কানে কহিলেন, তাহাতে আর লজ্জা কী ! এবং লজ্জা করিবার যে কোনো প্রয়োজন নাই। এ কথা তিনি স্কন্দ ও কঙ্কিপুরাণ হইতে উদাহরণ প্রয়োগ করিয়া প্রমাণ করিলেন । সার্বভৌমমহাশয় বিবাহ-আসনে উপবিষ্ট হইলেন । পুরোহিত মন্ত্র বলিবার সময় একটা ভুল করিল। সংস্কৃতে ভুল পণ্ডিতমহাশয়ের সহ্য হইল না, অমনি মুগ্ধবােধ ও পাণিনি হইতে গণ্ডা আষ্টেক সূত্র আওড়াইয়া ও তাঁহা ব্যাখ্যা করিয়া পুরোহিতের ভ্রম সংশোধন করিয়া দিলেন । পুরোহিত অপ্রস্তুত হইয়া ও ভেবাচেকা খাইয়া আরো কতকগুলি ভুল করিল। পণ্ডিতমহাশয় দেখিলেন যে, তিনি টােলে তাহাকে যাহা শিখাইয়াছিলেন পুরোহিত বাবাজি চাল-কলার সহিত তাহা নিঃশেষে হজম করিয়াছেন । বিবাহ হইয়া গেল। উঠিবার সময় সার্বভৌমমহাশয় কিরূপ বেগতিকে পায়ে পা জড়াইয়া তাহার শ্বশুরের ঘাড়ে পড়িয়া গেলেন, উভয়ে বিবাহসভায় ভূমিসাৎ হইলেন। বরের কাপড় ছিড়িয়া গেল, টােপর ভাঙিয়া গেল। শ্বশুরের শূলবেদনা ছিল, স্থূলকায় ভট্টাচাৰ্যমহাশয় তাহার উদর চাপিয়া পড়াতে তিনি বিষম চীৎকার করিয়া উঠিলেন। সাত-আট জন ধরাধরি করিয়া উভয়কে তুলিল, সভাশুদ্ধ লোক হাসিতে লাগিল, পণ্ডিতমহাশয় মর্মান্তিক অপ্ৰস্তুত হইলেন ও দুই-একটি কী কথা বলিলেন তাহার অর্থ বুঝা গেল না। একবার দৈবাৎ অপ্ৰস্তুত হইলে পদে পদে অপ্ৰস্তুত হইতেই হইবে । অতঃপুরে গিয়া গোলেমালে পণ্ডিতমহাশয় তাহার শাশুড়ির পা মাড়াইয়া দিলেন, তাহার শাশুড়ি ‘নাঃ- কিছু হয় নাই' বলিলেন ও অন্দরে গিয়া সিক্ত বস্ত্ৰখণ্ড তাহার পায়ের আঙুলে বাধিয়া আসিলেন । আহার করিবার সময় দৈবক্রমে গলায় জল বাধিয়া গেল, আধঘণ্টা ধরিয়া কাশিতে কাশিতে নেত্ৰ অশ্রুজালে ভরিয়া গেল। বাসর-ঘরে বসিয়া আছেন, এমন সময়ে একটা আর সুলা আসিয়া তাহার গায়ে উড়িয়া বসিল । অমনি লাফাইয়া ঝাপাইয়া, হাত পা ছড়াইয়া, মুখ বিকটাকার করিয়া তাহার শালীদের ঘাড়ের উপর গিয়া পড়িলেন। আবার দুইটি-চারিটি কান-মলা খাইয়া ঠিক স্থানে আসিয়া বসিলেন। একটা কথা ভুলিয়া গিয়াছি, স্ত্রী আচার করিবার সময় পণ্ডিতমহাশয় এমন উপযুপরি হাঁচিতে লাগিলেন যে চারি দিকের মেয়েরা বিব্রত হইয়া পড়িল । বাসর-ঘরের বিপদ হইতে কী করিয়া উদ্ধার হইবেন এ বিষয়ে পণ্ডিতমহাশয় অনেক ভাবিয়াছিলেন ; সহসা নিধিকে মনে পড়িয়াছিল, কিন্তু নিধির বাসর-ঘরে যাইবার কোনাে উপায় ছিল না। যাহা হউক, ভালোমানুষ বেচারি অতিশয় গােলে পড়িয়াছিলেন। শুনিয়াছি দুটি-একটি কী কথার উত্তর দিতে গিয়া স্মৃতি ও বেদান্তসূত্রের ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন । এবং যখন তাহাকে গান করিতে অনুরোধ করে, অনেক পীড়াপীড়ির পর গাহিয়াছিলেন ‘কোথায় তারিণী মা গো বিপদে তারাহ সুতে । এই তিনি মনের সঙ্গে গাহিয়াছিলেন তাহাতে আর সন্দেহ নাই । ভট্টাচাৰ্যমহাশয় রাগিণীর দিকে বড়ো একটা নজর করেন নাই, যে সুরে তিনি পুঁতি পড়িতেন সেই সুরেই গানটি গাহিয়াছিলেন। যাহা হউক, অনেক কষ্ট্রে বিবাহরাত্রি অতিবাহিত হইল।