পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Soo রবীন্দ্র-রচনাবলী পঞ্চম পরিচ্ছেদ মহেন্দ্র নরেন্দ্ৰদের দলে মিশিয়াছে বটে, কিন্তু এখনো মহেমেন্দ্রর আচার-ব্যবহারে এমন একটি মহত্ত্ব জড়িত ছিল যে, নরেন্দ্র তাহার সহিত ভালো করিয়া কথা কহিতে সাহস করিত না। এমনকি, সে থাকিলে নরেন্দ্ৰ কেমন একটা অসুখ অনুভব করিত, সে চলিয়া গেলে কেমন একটু শান্তিলাভ করিত। অলক্ষিতভাবে নরেন্দ্রের মন মহেন্দ্রের মোহিনীশক্তির পদানত হইয়াছিল । মহেন্দ্ৰ বড়ো মৃদুস্বভাব লোক- হাসিবার সময় মুচকিয়া হাসে, কথা কহিবার সময় মৃদুস্বরে কথা কহে, আবার অধিক লোকজন থাকিলে মূলেই কথা কহে না । সে কাহারও কথায় সায় দিতে হইলে ‘ই’ বলিত বটে, কিন্তু সায় দিবার ইচ্ছা না থাকিলে ‘হঁ’ও বলিত না, নাও বলিত না । এ মহেন্দ্ৰ নরেন্দ্রর মনের উপর যে অমন আধিপত্য স্থাপন করিবে তাহা কিছু আশ্চর্যের বিষয় বটে। মহেন্দ্রের সহিত গদাধরের বড়ো ভাব হইয়াছিল। ঘরে বসিয়া উভয়ে মিলিয়া দেশাচারের বিরুদ্ধে নিদারুণ কাল্পনিক সংগ্রাম করিতেন। স্বাধীনবিবাহ বিধবাবিবাহ প্রভৃতি প্রসঙ্গে মহেন্দ্ৰ সংস্কারক মহাশয়ের সহিত উৎসাহের সহিত য়োগ দিতেন, কিন্তু বহুবিবাহনিবারণ-প্রসঙ্গে তাহার তেমন উৎসাহ থাকিত না । এ ভাবের তাৎপর্য যদিও গদাধরবাবু বুঝিতে পারেন নাই, কিন্তু আমরা এক রকম বুঝিয়া লইয়াছি। r গদাধর ও স্বরূপের সঙ্গে মহেন্দ্রের যেমন বনিয়া গিয়াছিল, এমন নরেন্দ্র ও তাহার দলবলের সহিত হয় নাই। মহেন্দ্ৰ ইহাদের নিকট ক্রমে তাহার দুই-একটি করিয়া মনের কথা বলিতে লাগিল, অবশেষে মোহিনীর সহিত প্ৰণয়ের কথাটাও অবশিষ্ট রহিল না। এই প্ৰণয়ের কথাটা শুনিয়া স্বরূপবাবু অত্যন্ত উন্মত্ত হইয়া উঠিলেন। তিনি ভাবিলেন মহেন্দ্র তাহার প্রণয়ের অন্যায় প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়াছেন ; অনেক দুঃখ করিয়া অনেক কবিতা লিখিলেন এবং আপনাকে একজন উপন্যাস নাটকের নায়ক কল্পনা করিয়া মনে-মনে একটু তৃপ্ত হইলেন। গদাধর কোনো প্রকারে মোহিনীর পারিবারিক অধীনতাশূঙ্খল ভগ্ন করিয়া তাহাকে মুক্ত বায়ুতে, আনয়ন করিবার জন্য মহেন্দ্রকে অনুরোধ করিলেন। তিনি কাহেন, গৃহ হইতে আমাদের স্বাধীনতা শিক্ষা করা উচিত, প্রথমে পারিবারিক অধীনতা হইতে মুক্তিলাভ করিতে শিখিলে ক্রমশ আমরা স্বাধীনতাপথে অগ্রসর হইতে পারিব । ইংরাজি শাস্ত্রে লেখে : Charity begins at home । তেমনি গৃহ হইতে স্বাধীনতার শুরু । সংস্কারকমহাশয় নিজে বাল্যকাল হইতেই ইহার দৃষ্টান্ত দেখাইয়া আসিতেছেন। বারো বৎসর বয়সে পিতার সহিত বিবাদ করিয়া তিনি গৃহ হইতে নিরুদ্দেশ্য হন, ষোলো বৎসর বয়সে শিক্ষকের সহিত বিবাদ করিয়া ক্লাস ছাড়িয়া আসেন, কুড়ি বৎসর বয়সে তাহার স্ত্রীর সহিত মনান্তর হয় এবং তাহাকে তাহার বাপের বাড়ি পাঠাইয়া নিশ্চিন্ত হন এবং এইরূপে স্বাধীনতার সোপানে সোপানে উঠিয়া সম্প্রতি ত্রিশ বৎসর বয়সে নিজে সমস্ত কুসংস্কার ও প্রেজুডিসের অধীনতা হইতে মুক্ত হইয়া অসভ্য বঙ্গদেশের নির্দয় দেশাচারসমূহকে বক্তৃতার ঝটিকায় ভাঙিয়া ফেলিবার চেষ্টায় আছেন । কিন্তু গদাধরের সহিত মহেন্দ্রের মতের ঐক্য হইল না, এমন-কি, মহেন্দ্ৰ মনে-মনে একটু অসন্তুষ্ট হইল। গদাধর আর অধিক কিছু বলিল না ; ভাবিল, “আরো দিনকতক যাক, তাহার পরে পুনরায় এই কথা তুলিব ।” আরো দিনকতক গেল, মহেন্দ্ৰ এখন নরেন্দ্রদের দলে সম্পূর্ণরূপে যোগ দিয়েছে। মহেন্দ্রের মনে আর মনুষ্যত্বের কিছুমাত্র অবশিষ্ট নাই। গদাধর আর-একবার পূর্বকার কথা পাড়িল, মহেন্দ্রের তাহাতে কোনো আপত্তি হইল না । মহেন্দ্রের নামে কলঙ্ক ক্রমে রাষ্ট্র হইতে লাগিল। কিন্তু মহেন্দ্রের হৃদয়ে এতটুকু লোকলজ অবশিষ্ট ছিল না, যে এই অপবাদে তাহার মন তিলমাত্র ব্যথিত হইতে পারে । মহেন্দ্রের ভগিনী পিতা ও অন্যান্য আত্মীয়েরা ইহাতে কিছু কষ্ট পাইল বটে, কিন্তু হতভাগিনী রজনীর হৃদয়ে যেমন আঘাত লাগিল এমন আর কাহারও নয়। যখন মহেন্দ্ৰ-মদ খাইয়া এলোমেলো