পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

s Sno রবীন্দ্র-রচনাবলী নিধি লাল হইয়া কহিল, “দেখুন দেখি, মহাশয়, পাপাচারণ করিবার আর কি স্থান নাই। এই কাশীতে। ” এ কথা পণ্ডিতমহাশয় এতক্ষণ ভাবেন নাই। শুনিয়া তিনি কিয়ৎক্ষণ একদৃষ্টি অবাক হইয়া নিধির মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন ; ভাবিলেন, “সত্যই তো ! একটা ঘণ্টা বাজিল, মহা দুটাছুটি চেঁচামেচি পড়িয়া গেল। পণ্ডিতমহাশয় বেঞ্চের কাছে বোেচকা ফেলিয়া আসিয়াছিলেন, তাড়াতাড়ি লইতে গেলেন । এমন সময় স্বরূপ তাড়াতাড়ি করুণাকে ডাকিতে আসিল— পণ্ডিতমহাশয়কে দেখিয়া সট করিয়া সরিয়া পড়িল। করুণা কাতরস্বরে পণ্ডিতমহাশয়কে কহিল, “সার্বভৌমমহাশয়, আমাকে ফেলিয়া যাইবেন না ।” পণ্ডিতমহাশয় কহিলেন, “মা, অনেক প্রতারণা সহিয়াছি— মনে করিয়াছি বৃদ্ধবয়সে আর কোনো দিকে। মন দিব না- দেবসেবায় কয়েকটি দিন কাটাইয়া দিব ।” করুণা কঁদিতে কঁাদিতে পণ্ডিতমহাশয়ের পা জড়াইয়া ধরিল ; কহিল, “আমাকে ছাড়িয়া যাইবেন না- আমাকে ছাডিয়া যাইবেন না ।” পণ্ডিতমহাশয়ের নেত্ৰে অশ্রু পূরিয়া আসিল ; ভাবিলেন, “যাহা অদৃষ্ট আছে হইবে— ইহাকে তো ছাড়িয়া যাইতে পারিব না।” নিধি দুটিয়া আসিয়া মহা একটা ধমক দিয়া কহিল, “এখানে ইহা করিয়া দাড়াইয়া থাকিলে কী হইবে । গাড়ি যে চলিয়া যায় ।” এই বলিয়া পণ্ডিতমহাশয়ের হাত ধরিয়া হাড় হড়া করিয়া টানিয়া একটা গাড়ির মধ্যে পুরিয়া দিল। করুণা অন্ধকার দেখিতে লাগিল। মাথা ঘুরিয়া মুখচক্ষু বিবৰ্ণ হইয়া সেইখানে মুছিত হইয়া পড়িল । স্বরূপের দেখাসাক্ষাৎ নাই, সে গোলেমালে অনেকক্ষণ হইল গাড়িতে উঠিয়া পড়িয়ছে। অগ্নিময় অন্ধুশের তাপে আর্তনাদ করিয়া লীেহময় গজ হন হন করিয়া অগ্রসর হইল। স্টেশনে আর বড়ো লোক নাই । একবিংশ পরিচ্ছেদ এই সময়ে মহেন্দ্রের নিকট হইতে যেসকল পত্র পাইয়াছিলাম, তাহার একখানি নিম্নে উদধূত করিয়া দিলাম ভাই ! যে কষ্টে, যে লজ্জায়, যে আত্মাগ্লানির যন্ত্রণায় পাগল হইয়া দেশ পরিত্যাগ করিলাম তাহা তােমার কাছে গােপন করি নাই। সেই আঁধার রাত্রে বিজন পথ দিয়া যখন যাইতেছিলাম— কোনাে কারণ নাই, কোনো উদ্দেশ্য নাই, কোনো গম্য স্থান নাই- তখন কেন। যাইতেছি, কোথায় যাইতেছি। কিছুই ভাবি নাই। মনে করিয়াছিলাম এ পথের যেন অন্ত নাই, এমনি করিয়াই যেন আমাকে চিরজীবন চলিতে হইবে- চলিয়া, চলিয়া, চলিয়া। তবু পথ ফুরাইবে না— রাত্রি পোহাইবে না। মনের ভিতর কেমন এক প্রকার ঔদাস্যের অন্ধকার বিরাজ করিতেছিল, তাহা বলিবার নহে। কিন্তু রাত্রের অন্ধকার যত হ্রাস হইয়া আসিতে লাগিল, দিনের কোলাহল যতই জাগ্রত হইয়া উঠিতে লাগিল, ততই আমার মনের আবেগ কমিয়া আসিল । তখন ভালো করিয়া সমস্ত ভাবিবার সময় আসিল । কিন্তু তখনো দেশে ফিরিবার জন্য এক তিলও ইচ্ছা হয় নি। কত দেশ দেখিলাম, কত স্থানে ভ্ৰমণ করিলাম, কত দিন কত মাস চলিয়া গেল, কিন্তু কী দেখিলাম কী করিলাম কিছু যদি মনে আছে! চোখের উপর কত পর্বত নদী অরণ্য মন্দির অট্টালিকা গ্রাম উঠিত, কিন্তু সে-সকল যেন কী । কিছুই নয়। যেন স্বপ্নের মতো, যেন মায়ার মতো, যেন মেঘের পর্বত-অরণ্যের মতো। চােখের উপর পাড়িত তাই দেখিতাম, আর কিছুই নহে। এইরূপ করিয়া যে কত দিন গেল তাহা বলিতে পারি না— আমার মনে হইয়াছিল এক বৎসর হইবে, কিন্তু পরে গণনা করিয়া দেখিলাম চার মাস। ক্রমে ক্রমে আমার মন শান্ত হইয়া আসিয়াছে। এখন ভবিষ্যৎ ও অতীত ভাবিবার অবসর পাইলাম। আমি এখন লাহােরে আসিয়াছি ।