পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ) NRA. না। নিধিকে ঐ এক কথা বলিয়া এমন বিরক্ত করিয়া তুলিয়াছিলেন যে, সে একদিন কলিকাতায় ফিরিয়া যাইবার সমস্ত উদ্যোগ করিয়াছিল। মোহিনী কহিল, “তোমাদের পণ্ডিতমহাশয়কে তো আমি চিনি না, যদি চিনা শুনা হয়, তবে বলিব ।” । করুণা একেবারে অবাক হইয়া গেল। পণ্ডিতমহাশয়কে চিনে না ! সে জানিত পণ্ডিতমহাশয়কে সকলেই চিনে। সে মোহিনীকে বিশেষ করিয়া বুঝাইয়া দিল কোন পণ্ডিতমহাশয়ের কথা কহিতেছে, কিন্তু তাহাতেও যখন মোহিনী পণ্ডিতমহাশয়কে চিনিল না। তখন করুণা নিরাশ ও অবাক হইয়া গেল । কাদিতে কাদিতে রজনীর কাছে বিদায় লইয়া মোহিনী কাশী চলিয়া গেল । চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ বর্ষাকাল। দুই দিন ধরিয়া বাদলার বিরাম নাই। সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে, কলিকাতার রাস্তায় ছাতির অরণ্য পড়িয়া গিয়াছে। সসংকোচ পথিকদের সর্বাঙ্গে কাদা বর্ষণ করিতে করিতে গাড়ি ছুটিতেছে। মহেন্দ্র নরেন্দ্রের সন্ধানে বাহির হইয়াছেন। বড়ো রাস্তায় গাড়ি দাড় করাইয়া একটি অতি সংকীর্ণ অন্ধকার গলির মধ্যে প্রবেশ করিলেন। দুটা-একটা খোলার ঘর ভাঙিয়া-চুরিয়া পড়িতেছে ও তাহার দুই প্রৌঢ়া অধিবাসিনী অনেকক্ষণ ধরিয়া বকাবিকি করিয়া অবশেষে চুলচুলি করিবার বন্দােবস্ত করিতেছে। ভাঙা হাঁড়ি, পচা ভাত, আমের আঁটি ও পৃথিবীর আবর্জনা গলির যেখানে সেখানে রাশীকৃত রহিয়াছে। একটি দুৰ্গন্ধ পুষ্করিণীর তীরে আস্তাবল-রক্ষকের মহিলারা আঁচল ভরিয়া তাহদের আহারের জন্য উদ্ভিজ্জ সঞ্চয় করিতেছেন। ইহঁচট খাইতে খাইতে- কখনাে-বা এক-হাঁটু কাদায় কখনাে-বা এক-হাঁটু ঘোলা জলে জুতা ও পেন্টলুনটাকে পেন্সন দিবার কল্পনা করিতে করিতে- সর্বাঙ্গে কাদামাখা দুই-চারিটা কুকুরের নিকট হইতে অশ্রান্ত তিরস্কার শুনিতে শুনিতে মহেন্দ্ৰ গোবর-আচ্ছাদিত একটি অতি মুমূর্ষ বাটীতে গিয়া পৌঁছিলেন। দ্বারে আঘাত করিলেন, জীর্ণ শীর্ণ দ্বার বিরক্ত রোগীর মতো মৃদু আর্তনাদ করিতে করিতে খুলিয়া গেল। নরেন্দ্র গৃহে ছিলেন, কিন্তু বৎসর-কয়েকের মধ্যে পুলিসের কনস্টেবল ছাড়া নরেন্দ্রের গৃহে আর-কোনো অতিথি আসে নাই- এইজন্য দ্বার খুলিবার শব্দ শুনিয়াই নরেন্দ্ৰ অন্তর্ধান করিয়াছেন । দ্বার খুলিয়াই মহেন্দ্র আবর্জনা ও দুৰ্গন্ধ-ময় এক প্রাঙ্গণে পদার্পণ করিলেন । সে প্রাঙ্গণের এক পাশে একটা কৃপ আছে, সে কৃপের কাছে কতকগুলা আমের আঁটি হইতে ছোটাে ছোটাে চারা উঠিয়াছে। সে কুপের উপরে একটা পেয়ারা গাছ ঝুকিয়া পড়িয়াছে। প্রাঙ্গণ পার হইয়া সংকুচিত মহেন্দ্ৰ গৃহে প্রবেশ করিলেন । এমন নিম্ন ও এমন সঁ্যাৎসেঁতে ঘর বুঝি মহেন্দ্ৰ আর কখনো দেখে নাই, ঘর হইতে এক প্রকার ভিজা ভাপসা গন্ধ বাহির হইতেছে। বৃষ্টির আক্রমণ হইতে রক্ষা পাইবার জন্য ভগ্ন জানালায় একটা ছিন্ন দারমার আচ্ছাদন রহিয়াছে। সে গৃহের দেয়ালে যে এক কালে বালি ছিল, সে পাড়ায় এইরূপ একটা প্ৰবাদ আছে মাত্র । এক জায়গায় ইটের মধ্যে একটি গর্তে খানিকটা তামাক গোজা আছে। গৃহসজ্জার মধ্যে একখানি অবিশ্বাসজনক তক্তা (যদি তাহার প্রাণ থাকিত তবে তাহা ব্যবহার করিলে পশু-নৃশংসতানিবারিণী সভায় অনেক টাকা জরিমানা দিতে হইত)– তাহার উপরে। শুধু মদীক একখানি মাদুর ও তদুপযুক্ত বালিশ ও সর্বপরি স্বকার্য অক্ষা দীনহীন একটি গৃহে প্রবেশ করিয়া মহেন্দ্র একটি দাসীকে দেখিতে পাইলেন । সে দাসীটি তঁহাকে দেখিয়াই ঈষৎ হাসিতে হাসিতে মৃদু ভৎসনার স্বরে কহিল, “কেন গো বাবু, মানুষের গায়ের উপর না পড়িলেই কি নয় ।” মহেন্দ্র তাহার নিকট হইতে অন্তত দুই হস্ত ব্যবধানে ছিলেন ও তাহার দুৰ্গন্ধ বস্ত্র ও ভয়জনক মুখশ্ৰী