পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SObr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সে প্রফুল্ল, ভবিষ্যৎ তাহাকে অভিভূত করিয়া দেয় না। আবার ফলকে দেখিলে মনে হয়, সেই যেন সফলতার চূড়ান্ত ; কিন্তু ভাবী তরুর জন্য সে যে বীজকে গর্ভের মধ্যে পরিণত করিয়া তুলিতেছে, এ কথা অন্তরালেই থাকিয়া যায়। এমনি করিয়া প্রকৃতি ফুলের মধ্যে ফুলের চরমতা, ফলের মধ্যে ফলের চরমতা রক্ষা করিয়াও তাহদের অতীত একটি পরিণামকে অলক্ষ্যে অগ্রসর করিয়া দিতেছে । কাব্যরচনাসম্বন্ধেও সেই বিশ্ববিধানই দেখিতে পাই- অন্তত আমার নিজের মধ্যে তাহা উপলব্ধি করিয়াছি। যখন যেটা লিখিতেছিলাম তখন সেইটোকেই পরিণাম বলিয়া মনে করিয়াছিলাম । এইজন্য সেইটুকু সমাধা করার কাজেই অনেক যত্ন ও অনেক আনন্দ আকর্ষণ করিয়াছে। আমিই যে তাহা লিখিতেছি এবং একটা-কোনো বিশেষ ভােব অবলম্বন করিয়া লিখিতেছি, এ সম্বন্ধেও সন্দেহ ঘটে নাই । কিন্তু আজ জানিয়াছি, সে-সকল লেখা উপলক্ষমাত্ৰ— তাহারা যে অনাগতকে গড়িয়া তুলিতেছে সেই অনাগতকে তাহারা চেনেও না । তাহদের রচয়িতার মধ্যে আর-একজন কে রচনাকারী আছেন, র্যাহার সম্মুখে সেই ভাবী তাৎপর্য প্রত্যক্ষ বর্তমান। ফুৎকার বাঁশির এক-একটা ছিদ্রের মধ্য দিয়া এক-একটা সুর জাগাইয়া তুলিতেছে এবং নিজের কর্তৃত্ব উচ্চস্বরে প্রচার করিতেছে, কিন্তু কে সেই বিচ্ছিন্ন সুরগুলিকে রাগিণীতে বাধিয়া তুলিতেছে ? ফু সুর জাগাইতেছে বটে, কিন্তু যুঁ তো বাঁশি বাজাইতেছে না । সেই বঁশি যে বাজাইতেছে তাহার কাছে সমস্ত রাগরাগিণী বর্তমান আছে, তাহার অগোচরে কিছুই নাই । বলিতেছিলাম বসি এক ধারে আপনার কথা আপন জনারে, শুনাতেছিলাম ঘরের দুয়ারে ঘরের কাহিনী যত ; তুমি সে ভাষারে দহিয়া অনলে নবীন প্ৰতিমা নব কৌশলে গড়িলে মনের মতো । এই শ্লোকটার মানে বোধ করি এই যে, যেটা লিখতে যাইতেছিলাম সেটা সাদা কথা, সেটা বেশি। কিছু নহে- কিন্তু সেই সোজা কথা, সেই আমার নিজের কথার মধ্যে এমন একটা সুর আসিয়া পড়ে, যাহাতে তাহ বড়ো হইয়া ওঠে, ব্যক্তিগত না হইয়া বিশ্বের হইয়া ওঠে। সেই-যে সুরাটা, সেটা তো আমার অভিপ্ৰায়ের মধ্যে ছিল না । আমার পটে একটা ছবি দাগিয়াছিলাম বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে-সঙ্গে যে-একটা রঙ ফলিয়া উঠিল, সেই রঙ ও সে রঙের তুলি তো আমার হাতে ছিল না । নূতন ছন্দ অন্ধের প্রায় ভরা আনন্দে ছুটে চলে যায়, নূতন বেদনা বেজে উঠে তায় নূতন রাগিণীভরে। যে কথা ভাবি নি বলি সেই কথা, য়ে ব্যথা বুঝি না জাগে সেই ব্যথা, জানি না। এনেছি কাহার বারতা কারে শুনাবার তরে । আমি ক্ষুদ্র ব্যক্তি যখন আমার একটা ক্ষুদ্র কথা বলিবার জন্য চঞ্চল হইয়া উঠিয়ছিলাম তখন কে একজন উৎসাহ দিয়া কহিলেন, “বলো বলো, তোমার কথাটাই বলে। ঐ কথাটার জন্যই সকলে ই করিয়া তাকাইয়া আছে।” এই বলিয়া তিনি শ্রোতৃবর্গের দিকে চাহিয়া চোখ টিপিলেন ; স্নিগ্ধ প্রচুর সঙ্গে এশখন হাসিলন এবং আমারই কথার ভিতর দিয়া কী সব নিজের কথা বলিয়া