পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S8 রবীন্দ্র-রচনাবলী হত। যখন ঘনঘটা করে বর্ষার মেঘ উঠত। তখন তার ঘনশ্যামচ্ছটািয় আমার সমস্ত পল্লবকে একটি পরিচিত করতলের মতো স্পর্শ করত। তার পরেও নব নব যুগে এই পৃথিবীর মাটিতে আমি জন্মেছি। আমরা দুজনে একলা মুখোমুখি করে বসলেই আমাদের সেই বহুকালের পরিচয় যেন অল্পে অল্পে মনে পড়ে। আমার বসুন্ধরা এখন একখানি রৌদ্রপীতহিরণ্য অঞ্চল পরে ওই নদীতীরের শস্যক্ষেত্রে বসে আছেন- আমি তার পায়ের কাছে, কোলের কাছে গিয়ে লুটিয়ে পড়ছি। অনেক ছেলের মা যেমন অর্ধমনস্ক অথচ নিশ্চল সহিষ্ণুভাবে আপন শিশুদের আনাগোনার প্রতি তেমন দৃকপাত করেন না, তেমনি আমার পৃথিবী এই দুপুরবেলায় ঐ আকাশপ্রান্তের দিকে চেয়ে বহু আদিমকালের কথা ভাবছেন- আমার দিকে তেমন লক্ষ করছেন না, আর আমি কেবল অবিশ্রাম বকেই যাচ্ছি। প্রকৃতি তাহার রূপরস বর্ণগন্ধ লইয়া, মানুষ তাহার বুদ্ধিমন তাহার মেহপ্ৰেম লইয়া, আমাকে মুগ্ধ করিয়াছে- সেই মোহকে আমি অবিশ্বাস করি না, সেই মোহকে আমি নিন্দা করি না । তাহা আমাকে বদ্ধ করিতেছে না, তাহা আমাকে মুক্তই করিতেছে ; তাহা আমাকে আমার বাহিরেই ব্যাপ্ত করিতেছে। নীেকার গুণ নীেকাকে বাধিয়া রাখে নাই, নীেকাকে টানিয়া টানিয়া লইয়া চলিয়াছে।। জগতের সমস্ত আকর্ষণপােশ আমাদিগকে তেমনি অগ্রসর করিতেছে। কেহ বা দ্রুত চলিতেছে বলিয়া সে আপন গতিসম্বন্ধে সচেতন, কেহ-বা মন্দগমনে চলিতেছে বলিয়া মনে করিতেছে বুঝি-বা সে এক জায়গায় বাধাই পড়িয়া আছে। কিন্তু সকলকেই চলিতে হইতেছে- সকলই এই জগৎ সংসারের নিরন্তর টানে প্রতিদিনই নুনাধিক পরিমাণে আপনার দিক হইতে ব্ৰহ্মের দিকে ব্যাপ্ত হইতেছে। আমরা যেমনই মনে করি, আমাদের ভাই, আমাদের প্রিয়, আমাদের পুত্র আমাদিগকে একটি জায়গায় বাধিয়া রাখে নাই ; যে জিনিসটাকে সন্ধান করিতেছি, দীপালোক কেবলমাত্র সেই জিনিসটাকে প্রকাশ করে তাহা নহে, সমস্ত ঘরকে আলোকিত করে- প্ৰেম প্রেমের বিষয়কে অতিক্রম করিয়াও ব্যাপ্ত হয় । জগতের সৌন্দর্যের মধ্য দিয়া, প্রিয়জনের মাধুর্যের মধ্য দিয়া ভগবানই আমাদিগকে টানিতেছেন- “ আর-কাহারও টানিবার ক্ষমতাই নাই। পৃথিবীর প্রেমের মধ্য দিয়াই সেই ভূমানন্দের পরিচয় পাওয়া, জগতের এই রূপের মধ্যেই সেই অপরূপকে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করা, ইহাকেই তো আমি মুক্তির সাধনা বলি। জগতের মধ্যে আমি মুগ্ধ, সেই মোহেই আমার মুক্তিরসের আস্বাদন।-- বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয় । অসংখ্যবন্ধন-মাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ । এই বসুধার নানাবর্ণগন্ধময় । প্ৰদীপের মতো সমস্ত সংসার মোর লক্ষ বর্তিকায় তোমার মন্দিরমাঝে । ইন্দ্ৰিয়ের দ্বার রুদ্ধ করি যোগাসন, সে নহে আমার । । যে কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে তোমার আনন্দ রবে তারি মাঝখানে । মোহ মোর মুক্তিরূপে উঠিবে জ্বলিয়া, প্রেম মোর ভক্তিরূপে রহিবে ফলিয়া । আমি বালকবয়সে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ” লিখিয়ছিলাম— তখন আমি নিজে ভালো করিয়া বুঝিয়েছিলাম কি না জানি না- কিন্তু তাহাতে এই কথা ছিল যে, এই বিশ্বকে গ্ৰহণ করিয়া, এই সংসারকে বিশ্বাস করিয়া, এই প্ৰত্যক্ষকে শ্রদ্ধা করিয়া আমরা যথার্থভাবে অনন্তকে উপলব্ধি করিতে