পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S (፩ O রবীন্দ্র-রচনাবলী হইবে যেখানে আমার মাথা নত করিবার স্থান। অতএব এটুকু আমি আপনাদিগকে ভরসা দিতে পারি যে, আপনারা আমাকে যে সম্মান দিলেন তাহাকে আমার অহংকারের উপকরণরীপে ব্যবহার করিয়া অপমানিত করিব না । আমাদের দেশে বর্তমানকালে পঞ্চাশ পার হইলে আনন্দ করিবার কারণ আছে— কেননা দীর্ঘায়ু বিরল হইয়া,আসিয়াছে। যে দেশের লোক অল্পবয়সেই মারা যায়, প্রাচীন বয়সের অভিজ্ঞতার সম্পদ হইতে সে দেশ বঞ্চিত হয়। তারুণ্য তো ঘোড়া আর প্রবীণতাই সারথি । সারথিহীন ঘোড়ায় দেশের রথ চালাইলে কিরূপ বিষম বিপদ ঘটিতে পারে আমরা মাঝে মাঝে তাহার পরিচয় পাইয়াছি । অতএব এই অল্পায়ুর দেশে যে মানুষ পঞ্চাশ পার হইয়াছে তাহাকে উৎসাহ দেওয়া যাইতে পারে। কিন্তু কবি তো বৈজ্ঞানিক দার্শনিক ঐতিহাসিক বা রাষ্ট্রনীতিবিং নহে। কবিত্ব মানুষের প্ৰথমবিকাশের লাবণ্যপ্ৰভাতে। সম্মুখে জীবনের বিস্তার যখন আপনার সীমাকে এখনো খুজিয়া পায় । নাই, আশা যখন পরমরহস্যময়ী— তখনই কবিত্বের গান নব নব সুরে জাগিয়া উঠে । অবশ্য, এই রহস্যের সৌন্দর্যটি যে কেবল প্ৰভাতেরই সামগ্ৰী তাহা নহে, আয়ু-অবসানের দিনান্তকালেও অনন্তজীবনের পরামরহস্যের জ্যোতির্ময় আভাস আপনার গভীরতর সৌন্দৰ্য প্রকাশ করে । কিন্তু সেই কুর স্তৰ গান্ধীৰ গাল কলেেস্সরে মীর কক্সই দেয়। তাই বলতেছি, কবির কাসের মূল অতএব বার্ধক্যের আরম্ভে যে আদর লাভ করিলাম তাহাকে প্রবীণ বয়সের প্রাপ্য অর্ঘ্য বলিয়া গণ্য করিতে পারি না । আপনারা আমার এ বয়সেও তরুণের প্রাপ্যই আমাকে দান করিয়াছেন । তাঁহাই কবির প্রাপ্য । তাহা শ্রদ্ধা নহে, ভক্তি নহে, তাহা হৃদয়ের প্রীতি । মহত্ত্বের হিসাব করিয়া আমরা মানুষকে ভক্তি করি, যোগ্যতার হিসাব করিয়া তাহাকে শ্রদ্ধা করিয়া থাকি, কিন্তু গ্ৰীতির কোনো হিসাবকিতাব নাই। সেই প্রেম যখন যজ্ঞ করিতে বসে তখন নির্বিচারে আপনাকে রিক্ত করিয়া দেয় । ‘বুদ্ধির জোরে নয়, বিদ্যার জোরে নয়, সাধুত্বের গীেরবে নয়, যদি অনেক কাল বাঁশি বাজাইতে বাজাইতে তাঁহারই কোনো একটা সুরে আপনাদের হৃদয়ের সেই গ্ৰীতিকে পাইয়া থাকি তবে আমি ধনী হইয়াছি- তবে আমার আর সংকোচের কোনো কথা নাই। কেননা, আপনাকে দিবার বেলায় প্রীতির যেমন কোনো হিসাব থাকে না, তেমনি যে লোক ভাগ্যক্রমে তাহা পায় নিজের যোগ্যতার হিসাব লইয়া তাহারও কুষ্ঠিত হইবার কোনো প্রয়োজন নাই। যে মানুষ প্ৰেম'দান করিতে পারে ক্ষমতা তাহারইযে মানুষ প্রেম লাভ করে তাহার কেবল সৌভাগ্য। প্রেমের ক্ষমতা যে কতবড়ো আজ আমি তাহা বিশেষরূপে অনুভব করিতেছি । আমি যাহা পাইয়াছি তাহা সস্তা জিনিস নহে। আমরা ভৃত্যকে যে বেতন চুকাইয়া দিই তাহা তুচ্ছ, স্তুতিবাদককে যে পুরস্কার দিই তাহা হেয় । সেই অবজ্ঞার দান আমি প্রার্থনা করি নাই, আপনারাও তাঁহা দেন নাই। আমি প্রেমেরই দান পাইয়াছি। সেই প্রেমের একটি মহৎ পরিচয় আছে । আমরা যে জিনিসটার দাম দিই তাহার ক্রটি সহিতে পারি না- কোথাও ফুটা বা দাগ দেখিলে দাম ফিরাইয়া লইতে চাই। যখন মজুরি দিই তখন কাজের ভুলচুকের জন্য জরিমানা করিয়া থাকি । কিন্তু প্রেম অনেক সহ্য করে, অনেক ক্ষমা করে ; আঘাতকে গ্ৰহণ করিয়াই সে আপনার মহত্ত্ব প্রকাশ করে । আজ চল্লিশ বৎসরের উধ্বকাল সাহিত্যের সাধনা করিয়া আসিয়াছি— ভুলচুক যে অনেক করিয়াছি এবং আঘাতও যে বারংবার দিয়াছি তাহাতে কোনোই সন্দেহ থাকিতে পারে না । আমার সেই সমস্ত অপূর্ণতা, আমার সেই সমস্ত কঠোরতা-বিরুদ্ধতার উর্ধে দাড়াইয়া আপনারা আমাকে যে মাল্য দান করিয়াছেন তাহা প্রীতির মাল্য ছাড়া আর-কিছুই হইতে পারে না। এই দানেই আপনাদের যথার্থ গৌরব এবং সেই গৌরবেই। আমি গৌরবান্বিত । যেখানে প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়ম প্রবল সেখানে প্ৰাকৃতিক প্রাচুর্যের প্রয়োজন আছে। যেখানে । অনেক জন্মে সেখানে মরেও বেশি- তাহার মধ্য হইতে কিছু টিকিয়া যায়। কবিদের মধ্যে যাহারা কলানিপুণ, র্যাহারা আর্টিস্ট, তাহারা মানসিক নির্বাচনের নিয়মে সৃষ্টি করেন, প্রাকৃতিক নির্বাচনকে কাছে