পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মপরিচয় >Q○ সৃষ্টির পক্ষে এই বিচিত্ৰতা বহুমূল্য সামগ্ৰী। এইজন্যে একে সম্পূর্ণ নষ্ট করবার শক্তি আমাদের হাতে নেই। আমি সাম্যনীতিকে যতই মানি নে কেন, তবু অন্য-সকলের সঙ্গে আমার চেহারার বৈষম্যকে । আমি কোনোমতেই লুপ্ত করতে পারি নে। তেমনি সাম্প্রদায়িক সাধারণ নাম গ্ৰহণ করে আমি যতই । মনে করি।-না কেন যে, আমি সম্প্রদায়ের সকলেরই সঙ্গে সমান ধর্মের, তবু আমার অন্তর্যামী জানেন মনুষ্যত্বের মূলে আমার ধর্মের একটি বিশিষ্টতা বিরাজ করছে। সেই বিশিষ্টতাতেই আমার অন্তর্যমীর বিশেষ আনন্দ । কিন্তু পূর্বেই বলেছি, যেটা বাইরে থেকে দেখা যায় সেটা আমার সাম্প্রদায়িক ধর্ম। সেই সাধারণ পরিচয়েই লোকসমাজে আমার ধর্মগত পরিচয় । সেটা যেন আমার মাথার উপরকার পাগড়ি। কিন্তু যেটা আমার মাথার ভিতরকার মগজ, যেটা অদৃশ্য, যে পরিচয়টি আমার অন্তর্যামীর কাছে ব্যক্ত, হঠাৎ বাইরে থেকে কেউ যদি বলে, তার উপরকার প্রাণময় রহস্যের আবরণ ফুটাে হয়ে সেটা বেরিয়ে পড়েছে, এমন-কি, তার উপাদান বিশ্লেষণ করে তাকে যদি বিশেষ একটা শ্রেণীর মধ্যে বদ্ধ করে দেয়, তা হলে চমকে উঠতে হয় । আমার সেই অবস্থা হয়েছে। সম্প্রতি কোনো কাগজে একটি সমালোচনা বেরিয়েছে, তাতে জানা গেল আমার মধ্যে একটি ধর্মতত্ত্ব আছে এবং সেই তত্ত্বটি একটি বিশেষ শ্রেণীর । , হঠাৎ কেউ যদি আমাকে বলত আমার প্রেতিমূর্তিটা দেখা যাচ্ছে, তা হলে সেটা যেমন একটা ভাবনার কথা হত এও তার চেয়ে কম নয়। কেননা মানুষের মর্তলীলা সাঙ্গ না হলে প্রেতলীলা শুরু হয় না । আমার প্রেতিটি দেখা দিয়েছে। এ কথা বললে এই বোঝায় যে, আমার বর্তমান আমার পক্ষে আর সত্য নয়, আমার অতীতটাই আমার পক্ষে একমাত্র সত্য। আমার ধর্ম আমার জীবনেরই মূলে। সেই জীবন এখনো চলছে- কিন্তু মাঝে থেকে কোনো-এক সময়ে তার ধর্মটা এমনি থেমে গিয়েছে যে, তার উপরে টিকিট মেরে তাকে জাদুঘরে কৌতুহলী দর্শকদের চােখের সম্মুখে ধরে রাখা যায়, এই সংবাদটা বিশ্বাস করা শক্ত । কয়েক বৎসর পূর্বে অন্য একটি কাগজে অন্য একজন লেখক আমার রচিত ধর্মসংগীতের একটি সমালোচনা বের করেছিলেন। তাতে বেছে বেছে আমার কাচাবয়সের কয়েকটি গান দৃষ্টান্তস্বরূপ চেপে ধরে তিনি তঁর ইচ্ছামত সিদ্ধান্ত গড়ে তুলেছিলেন। যেখানে আমি থামি নি সেখানে আমি থেমেছি এমন ভাবের একটা ফোটােগ্রাফ তুললে মানুষকে অপদস্থ করা হয়। চলতি ঘোড়ার আকাশে-পা-তোলা ছবির থেকে প্রমাণ হয় না যে, বরাবর তার পা আকাশেই তোলা ছিল এবং আকাশেই তোলা আছে। এইজন্যে চলার ছবি ফোটোগ্রাফে হাস্যকর হয়, কেবলমাত্র আর্টিস্টের তুলিতেই তার রূপ ধরা পড়ে। কিন্তু কথাটা হয়তো সম্পূর্ণ সত্য নয়। হয়তো যার মূলটা চেতনার অগোচরে তার ডগার দিকের কোনো-একটা প্রকাশ বাইরে দৃশ্যমান হয়েছে। সেইরকম দৃশ্যমান হবামাত্র বাইরের জগতের সঙ্গে তার একটা ব্যবহার আরম্ভ হয়েছে । যখনই সেই ব্যবহার আরম্ভ হয় তখনই জগৎ আপনার কাজের সুবিধার জন্য তাকে কোনো-একটা বিশেষ শ্রেণীর চিহ্নে চিহ্নিত করে তবে নিশ্চিম্ভ হয় । নইলে তার দাম ঠিক করা বা প্রয়োজন ঠিক করা চলে না। বাইরের জগতে মানুষের যে পরিচয় সেইটোতেই তার প্রতিষ্ঠা। বাইরের এই পরিচয়টি যদি তার ভিতরের সত্যের সঙ্গে কোনো অংশে না মেলে তা হলে তার অস্তিত্বের মধ্যে একটা আত্মবিচ্ছেদ ঘটে । কেননা মানুষ যে কেবল নিজের মধ্যে আছে তা নয়, সকলে তাকে যা জানে সেই জানার মধ্যেও সে অনেকখানি আছে। ‘আপনাকে জানাে এই কথাটাই শেষ কথা নয়, “আপনাকে জানাও' এটাও খুব বড়ো কথা । সেই আপনাকে জানাবার চেষ্টা জগৎ জুড়ে রয়েছে। আমার অন্তনিহিত ধর্মতত্ত্বও নিজের মধ্যে নিজেকে ধারণ করে রাখতে পারে না- নিশ্চয়ই আমার গোচরে ও অগোচরে নানারকম করে। বাইরে নিজেকে জানিয়ে চলেছে। এই জানিয়ে চলার কোনােদিন শেষ নেই। এর মধ্যে যদি কোনো সত্য থাকে তা হলে মৃত্যুর S8 SS