পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মপরিচয় እ (፩ (፩ কিছুকে দেখে না। কিন্তু এমন ছেলেও আছে ইস্কুলের সাধনার দুঃখকে স্বেচ্ছায়, এমন-কি, আনন্দে যে গ্রহণ করে, যেহেতু ইস্কুলের অভিপ্ৰায়কে সে মনের মধ্যে সত্য করে উপলব্ধি করেছে। এই অভিপ্রায়কে সত্য করে জানছে বলেই সে যে মুহুর্তে দুঃখকে পাচ্ছে সেই মুহুর্তে দুঃখকে অতিক্রম করছে, যে মুহুর্তে নিয়মকে মানছে সেই মুহুর্তে তার মন তার থেকে মুক্তিলাভ করছে। এই মুক্তিই সত্যকার মুক্তি । সাধনা থেকে এড়িয়ে গিয়ে মুক্তি হচ্ছে নিজেকে ফাকি দেওয়া । জ্ঞানের পরিপূর্ণতার একটি আনন্দচ্ছবি এই ছেলেটি চােখের সামনে দেখতে পাচ্ছে বলেই উপস্থিত সমস্ত অসম্পূর্ণতাকে, সমস্ত দুঃখকে, সমস্ত বন্ধনকে সে সেই আনন্দেরই অন্তর্গত করে জািনছে। এ ছেলের পক্ষে পালানাে একেবারে অসম্ভব। তার যে আনন্দ দুঃখকে স্বীকার করে সে আনন্দ কিছু না করার চেয়ে বড়ো, সে আনন্দ খেলা করার চেয়ে বড়ো । সে আনন্দ শান্তির চেয়ে বড়ো, সে আনন্দ বঁাশির তানের চেয়ে বড়ো । এখন কথা হচ্ছে এই যে, আমি কোন ধর্মকে স্বীকার করি। এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমি যখন “আমার ধর্ম কথাটা ব্যবহার করি তখন তার মানে এ নয় যে আমি কোনো একটা বিশেষ ধর্মে সিদ্ধিলাভ করেছি। যে বলে আমি খৃস্টান সে যে খুস্টের অনুরূপ হতে পেরেছে তা নয়- তার ব্যবহারে প্রত্যহ খৃস্টানধর্মের বিরুদ্ধতা বিস্তর দেখা যায়। আমার কর্ম, আমার বাক্য কখনো আমার ধর্মের বিরুদ্ধে যে চলে না। এতবড়ো মিথ্যা কথা বলতে আমি চাই নে । কিন্তু প্রশ্ন এই যে, আমার ধর্মের আদর্শটি কী । বাইরে আমার রচনার মধ্যে এর উত্তর নানা জায়গাতেই আছে । অন্তরেও যখন নিজেকে এই প্রশ্ন করি। তখন আমার অন্তরাত্মা বলে- আমি তো কিছুকেই ছাড়বার পক্ষপাতী নই, কেননা সমস্তকে নিয়েই আমি সম্পূর্ণ। আমি যে সব নিতে চাই রে আপনাকে ভাই মেলব যে বাইরে । যখন কোনো অংশকে বাদ দিয়ে তবে সত্যকে সত্য বলি তখন তাকে অস্বীকার করি । সত্যের লক্ষণই এই যে, সমস্তই তার মধ্যে এসে মেলে । সেই মেলার মধ্যে আপাতত যতই অসামঞ্জস্য প্রতীয়মান হােক তার মূলে একটা গভীর সামঞ্জস্য আছে, নইলে সে আপনাকে আপনি হনন করত। অতএব, সামঞ্জস্য সত্যের ধর্ম বলে বাদসাদ দিয়ে গোজামিলন দিয়ে একটা ঘর-গড়া সামঞ্জস্য গড়ে তুললে সেটা সত্যকে বাধাগ্ৰস্ত করে তোলে। এক সময়ে মানুষ ঘরে বসে ঠিক করেছিল যে, পৃথিবী একটা পদ্মফুলের মতো- তার কেন্দ্ৰস্থলে সুমেরু পর্বতটি যেন বীজকোষ- চারিদিকে এক-একটি পাপড়ির মতো এক-একটি মহাদেশ প্রসারিত। এরকম কল্পনা করবার মূল কথাটা হচ্ছে এই যে, সত্যের একটি সুষমা আছে- সেই সুষমা না থাকলে সত্য আপনাকে আপনি ধারণ করে রাখতে পারে না । এ কথাটা যথার্থ। কিন্তু এই সুষমােটা বৈষম্যকে বাদ দিয়ে নয়- বৈষম্যকে গ্ৰহণ করে এবং অতিক্রম করে- শিব যেমন সমুদ্রমন্থনের সমস্ত বিষকে পান করে তবে শিব। তাই সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা করে তবে শিব। তাই সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা করে পৃথিবীটি বস্তুত যেমন, অর্থাৎ নানা অসমান অংশে বিভক্ত, তাকে তেমনি করেই জািনবার সাহস থাকা চাই। ছাট-দেওয়া সত্য এবং ঘর-গড়া সামঞ্জস্যের প্রতি আমার লোভ নেই। আমার লোভ আরো বেশি, তাই আমি অসামঞ্জস্যকেও ভয় করি নে। যখন বয়স অল্প ছিল তখন নানা কারণে লোকালয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল না, তখন নিভৃতে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গেই ছিল আমার একান্ত যোগ। এই যোগটি সহজেই শান্তিময়, কেননা এর মধ্যে দ্বন্দ্ব নেই, বিরোধ নেই, মনের সঙ্গে মনের- ইচ্ছার সঙ্গে ইচ্ছার সংঘাত নেই। এই অবস্থা ঠিক শিশুকালেরই সত্য অবস্থা। তখন অন্তঃপুরের অন্তরালে শান্তি এবং মাধুর্যেরই দরকার। বীজের দরকার মাটির বুকের মধ্যে বিরাট পৃথিবীর পর্দার আড়ালে শান্তিতে রস শোষণ করা। ঝড়বৃষ্টিরৌদ্রছায়ার ঘাতপ্রতিঘাত তখন তার জন্যে নয়। তেমনি এই বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে প্রচ্ছন্ন অবস্থায়