পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মপরিচয় S6 হন, মন্ত্রের যোগে নয়, জাদুমূলক অনুষ্ঠানের যোগে নয়। তাই ধী এবং আনন্দ এই দুই শক্তিকে এখানকার সৃষ্টিকার্যে নিযুক্ত করতে চিরদিন চেষ্টা করেছি। এখানে যেমন আহবান করেছি। প্রকৃতির সঙ্গে আনন্দের যোগ, তেমনি একান্ত ইচ্ছা করেছি। এখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগকে অন্তঃকরণের যোগ করে তুলতে। কর্মের ক্ষেত্রে যেখানে অন্তঃকরণের যোগধারা কৃশ হয়ে ওঠে। সেখানে নিয়ম হয়ে ওঠে একেশ্বর। সেখানে সৃষ্টিপরতার জায়গায় নির্মাণপরতা আধিপত্য স্থাপন করে । ক্রমশই সেখানে যন্ত্রীর যন্ত্র কবির কাব্যকে অবজ্ঞা করবার অধিকার পায় । কবির সাহিত্যিক কাব্য যে ছন্দ ও ভাষাকে আশ্রয় করে প্রকাশ পায় সে একান্তই তার নিজের আয়ত্তাধীন। কিন্তু যেখানে বহু লোককে নিয়ে সৃষ্টি সেখানে সৃষ্টিকার্যের বিশুদ্ধতা-রক্ষা সম্ভব হয় না। মানবসমাজে এইরকম অবস্থাতেই আধ্যাত্মিক তপস্যা সাম্প্রদায়িক অনুশাসনে মুক্তি হারিয়ে পাথর-হয়ে ওঠে। তাই এইটুকু মাত্র আশা করতে পারি যে ভবিষ্যতে প্ৰাণহীন দলীয় নিয়মজালের জটিলতা এই আশ্রমের মূলতত্ত্বকে একেবারে বিলুপ্ত করে দেবে না। জানি নে আর কখনো উপলক্ষ হবে কি না, তাই আজ আমার আশি বছরের আয়ুঃক্ষেত্রে দাড়িয়ে নিজের জীবনের সত্যকে সমগ্রভাবে পরিচিত করে যেতে ইচ্ছা করেছি। কিন্তু সংকল্পের সঙ্গে কাজের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য কখনােই সম্ভবপর হয় না। তাই নিজেকে দেখতে হয় অন্তদিকের প্রবর্তনা ও বহিদিকের অভিমুখিতা থেকে । আমি আশ্রমের আদর্শ রূপে বার বার তপোবনের কথা বলেছি। সে তপোবন ইতিহাস বিশ্লেষণ করে পাই নি । সে পেয়েছি। কবির কাব্য থেকেই। তাই স্বভাবতই সে আদর্শকে আমি কাব্যরূপেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছি। বলতে চেয়েছি পশ্য দেবস্য কাব্যম, মানবরূপে দেবতার কাব্যকে দেখো । আবাল্যকাল উপনিষদ আবৃত্তি করতে করতে আমার মন বিশ্বব্যাপী পরিপূর্ণতাকে অন্তদৃষ্টিতে মানতে অভ্যাস করেছে। সেই পূর্ণতা বস্তুর নয়, সে আত্মার ; তাই তাকে স্পষ্ট জানতে গেলে বস্তুগত আয়োজনকে লঘু করতে হয়। র্যারা প্ৰথম অবস্থায় আমাকে এই আশ্রমের মধ্যে দেখেছেন তারা নিঃসন্দেহ জানেন এই আশ্রমের স্বরূপটি আমার মনে কিরকম ছিল । তখন উপকরণবিরলতা ছিল এর বিশেষত্ব । সরল জীবনযাত্রা এখানে চার দিকে বিস্তার করেছিল সত্যের বিশুদ্ধ স্বচ্ছতা । খেলাধুলায় গানে অভিনয়ে ছেলেদের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ অবারিত হত নবনবোন্মেষশালী আত্মপ্রকাশে । যে শাস্তকে শিবকে অদ্বৈতাকে ধ্যানে অন্তরে আহবান করেছি তখন তাকে দেখা সহজ ছিল কর্মে। কেননা, কর্ম ছিল সহজ, দিনপদ্ধতি ছিল সরল, ছাত্রসংখ্যা ছিল স্বল্প, এবং অল্প যে-কয়জন শিক্ষক ছিলেন আমার সহযোগী তারা অনেকেই বিশ্বাস করতেন, এতস্মিয়ু খলু অক্ষরে আকাশ ওতশ্চ প্রোতশ্চ— এই অক্ষরপুরুষে আকাশ ওতপ্ৰেত। তারা বিশ্বাসের সঙ্গেই বলতে পারতেন, তমেবৈকং জানাথ আত্মানম— সেই এককে জানাে, সর্বব্যাপী আত্মাকে জানাে, আত্মন্যেব, আপনি আত্মাতেই, প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠানে নয় মানবপ্রেমে, শুভকর্মে, বিষয়বুদ্ধিতে নয় আত্মার প্রেরণায়। এই আধ্যাত্মিক শ্রদ্ধার আকর্ষণে তখনকার দিনকৃত্যের অর্থদৈন্যে ছিল ধৈর্যশীল ত্যাগধর্মের উজ্জ্বলতা । সেই একদিন তখন বালক ছিলাম। জানি নে কোন উদয়পথ দিয়ে প্রভাতসূর্যের আলোক এসে সমস্ত মানবসম্বন্ধকে আমার কাছে অকস্মাৎ আত্মার জ্যোতিতে দীপ্তিমান করে দেখিয়েছিল। যদিও সে আলোক প্রাত্যহিক জীবনের মলিনতায় অনতিবিলম্বে বিলীন হয়ে গেল, তবু মনে আশা করেছিলুম পৃথিবী থেকে অবসর নেবার পূর্বে একদিন নিখিল মানবকে সেই এক আত্মার আলোকে প্ৰদীপ্তরূপে প্রত্যক্ষ দেখে যেতে পারব। কিন্তু অন্তরের উদয়াচলে সেই জ্যোতিপ্রবাহের পথ নানা কুহেলিকায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। তা হােক, তবু জীবনের কর্মক্ষেত্রে আনন্দের সঞ্চিত সম্বল কিছু দেখে যেতে পারলুম। এই আশ্রমে একদিন যে যজ্ঞভূমি রচনা করেছি। সেখানকার নিঃস্বাৰ্থ অনুষ্ঠানে সেই মানবের আতিথ্য রক্ষা করতে পেরেছি। যাকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে “অতিথিদেবো ভব” । অতিথির মধ্যে আছেন দেবতা । কর্মসফলতার অহংকার মনকে অধিকার করে নি তা বলতে পারি নে, কিন্তু সেই দুর্বলতাকে অতিক্রম করে উদবেল হয়েছে আত্মোৎসর্গের চরিতার্থতা। এখানে দুর্লভ সুযোগ পেয়েছি