পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sbrin রবীন্দ্র-রচনাবলী নাট্যমঞ্চের সঙ- আজ নেপথ্যে উকি মারলে তাকে আর চেনাই চায় না ; এমন ফকির জগতে সত্য যদি কাউকে বলা যায়। তবে তার প্রতীক বাজার-দরের বাইরেকার আমরা কটিই, এই তলানিতেলের শিশি, এই দাঁতভাঙা চিরুনি আর ক্ষয়ে-যাওয়া পাতলা সাবানের টুকরো ; আমরা রােয়ল, আমরা ঝাটানি-মালের ঝুড়ি থেকে আধুনিকতার রসদ জোগাই। আমাদের কথা ফুরোয় যেই, দেখা যায়, নাট গাছটি মুড়িয়েছে।” কালের গোয়ালঘরের দরজা খোলা, তার গোরুতে দুধ দেয় না, কিন্তু নােট গাছটি মুড়িয়ে খায়। তাই আজ মানুষের সব আশাভরসা-ভালোবাসার মুড়োনো নাটে গাছটার এত দাম বেড়ে গেছে, কবিত্বের হাটে । গোরুটাও হাড়-বের করা, শিঙভাঙা, কাকের-ঠোকর-খাওয়া-ক্ষত পৃষ্ঠ, গাড়োয়ানের মোচর খেয়ে খেয়ে গ্রস্থিশিথিল-ল্যাজ-ওয়ালা হওয়া চাই । লেখকের অনবধানে এ যদি সুস্থ সুন্দর হয় তা হলে মিডভিকাটারীয়-যুগাবতী অপবাদে লাঞ্ছিত হয়ে আধুনিক সাহিত্যক্ষেত্রে তাড়া খেয়ে মরতে যাবে সমালোচকের কশাইখানায় । বৈশাখ ১৩৪৫ সাহিত্যের মাত্রা বর্তমান যুগে পূর্ব যুগের থেকে মানুষের প্রকৃতি পরিবর্তন হয়েছে, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে না । এখনকার মানুষ জীবনের যে-সব সমস্যা পূরণ করতে চায় তার চিন্তাপ্ৰণালী প্রধানত বৈজ্ঞানিক, তার প্রবৃত্তি বিশ্লেষণের দিকে, এইজন্যে তার মননবস্তু জমে উঠেছে বিচিত্র রূপে এবং প্রভূত পরিমাণে । কাব্যের পরিধির মধ্যে তার সম্পূর্ণ স্থান হওয়া সম্ভবপর নয়। সাবেক কালে তীতি যখন কাপড় তৈরি করত তখন চরকায় সুতো কাটা থেকে আরম্ভ করে কাপড় বোনা পর্যন্ত সমস্তই সরল গ্রামা জীবনযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলত। বিজ্ঞানের প্রসাদে আধুনিক বাণিজ্যপদ্ধতিতে চলছে প্ৰভূত পণ্য-উৎপাদন । তার জন্য প্ৰকাণ্ড ফ্যাক্টরির দরকার । চার দিকের মানবসংসারের সঙ্গে তার সহজ মিল নেই। এইজন্যে এক-একটা কারখানার শহর পরিস্ফীত হয়ে উঠছে, ধোয়াতে কালিতে যন্ত্রের গৰ্জনে ও আবর্জনায় তারা জড়িত বেষ্টিত, সেইসঙ্গে গুচ্ছ গুচ্ছ বিস্ফোটকের মতো দেখা দিয়েছে মজুর-বসতি। এক দিকে বিরাট যন্ত্রশক্তি উদগার করছে অপরিমিত বস্তুপিণ্ড, অন্য দিকে মলিনতা ও কঠোরতা শব্দে গন্ধে দৃশ্যে স্তুপে পুঞ্জীভূত হয়ে উঠছে। এর প্রবলত্ব ও বৃহত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কারখানাঘরের সেই প্রবলত্ব ও বৃহত্ব সাহিত্যে দেখা দিয়েছে উপন্যাসে, তার ভুরি আনুষঙ্গিকতা নিয়ে। ভালো লাগুক মন্দ লাগুক, আধুনিক সভ্যতা আপন কারখানাহাটের জন্যে সুপরিমিত স্থান নির্দেশ করতে পারছে না। এই অপ্ৰাণপদার্থ বহু শাখায় প্রকাণ্ড হয়ে উঠে প্ৰাণের আশ্রয়কে দিচ্ছে কোণঠাসা করে। উপন্যাসসাহিত্যেরও সেই দশা। মানুষের প্রাণের রূপ চিন্তার স্তুপে চাপা পড়েছে। বলতে পাের, বর্তমানে এটা অপরিহার্য ; তাই বলে বলতেপার না, এটা সাহিত্য । হাটের জায়গা প্রশস্ত করবার জন্যে মানুষকে ঘর ছাড়তে হয়েছে, তাই বলে বলতে পার না, সেটাই লোকালয় । এখনকার মানুষের প্রবৃত্তি বুদ্ধিগত সমস্যার অভিমুখে, সে কথা অস্বীকার করব না। তার চিন্তায় বাক্যে ব্যবহারে এই বুদ্ধির আলোড়ন চলছে। চন্সর-এর ‘ক্যান্টরবরি টেলস এ তখনকার কালের মানবসংসারের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। এখনকার মানুষের মধ্যে যে সেই পরিচয় একেবারেই নেই তা নয়। অনুভবের দিকে অনেক পরিমাণে আছে, কিন্তু চিন্তায় মানুষ তার সেদিনকার গণ্ডি অনেকদূর ছাড়িয়ে গেছে। অতএব ইদানীন্তন সাহিত্যে যখন মানুষ দেখা যায়, তখন ভাবে চলায় বলায় সেদিনকার নকল করলে সম্পূর্ণ অসংগত হবে। তার জীবনে চিন্তার বিষয় সর্বদা উদগত হয়ে