পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sbሆ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী সমালোচক যেরকম আদর্শের ষোলো-আনা উৎকর্ষ যাচাই করে সাহিত্যে চরিত্রের বিচার করে থাকে সে আদর্শ এখানে খাটে না ।” রামায়ণের কবি কোনো-একটা মতসংগতির লজিক দিয়ে রামের চরিত্র বানান নি, অর্থাৎ সে চরিত্র স্বভাবের, সে চরিত্র সাহিত্যের, সে চরিত্র ওকালতির নয় । কিন্তু উত্তরকাণ্ড এল বিশেষ কালের বুলি নিয়ে ; কাচপোকা যেমন তেলাপোকাকে মারে তেমনি করে চরিত্রকে দিলে মেরে । সামাজিক প্রয়োজনের গুরুতর তাগিদ এসে পড়ল, অর্থাৎ তখনকার দিনের প্রবলেম। সে যুগে ব্যবহারের যে আটঘটি বীধবার দিন এল তাতে রাবণের ঘরে দীর্ঘকাল বাস করা সত্ত্বেও সীতাকে বিনা প্রতিবাদে ঘরে তুলে নেওয়া আর চলে না। সেটা যে অন্যায় এবং লোকমতকে অগ্রগণ্য করে সীতাকে বনে পাঠানাের এবং অবশেষে তীর অগ্নিপরীক্ষার যে প্রয়ােজন আছে, সামাজিক সমস্যার এই সমাধান চরিত্রের ঘাড়ে ভূতের মতো চেপে বসল। তখনকার সাধারণ শ্রোতা সমস্ত ব্যাপারটাকে খুব একটা উচুদরের সামগ্ৰী বলেই কবিকে বাহবা দিয়েছে। সেই বাহবার জোরে ঐ জোড়াতাড়া খণ্ডটা এখনো মূল রামায়ণের সজীব দেহে সংলগ্ন হয়ে আছে। আজকের দিনের একটা সমস্যার কথা মনে করে দেখা যাক। কোনো পতিব্ৰতা হিন্দু স্ত্রী মুসলমানের ঘরে অপহৃত হয়েছে। তার পরে তাকে পাওয়া গেল। সনাতনী ও অধুনাতনী লেখক এই প্রবলেমটাকে নিয়ে আপন কক্ষের সমর্থনরূপে তাদের নভেলে লম্বা লম্বা তর্ক স্তুপাকার করে তুলতে পারেন । এরকম অত্যাচার কাব্যে গৰ্হিত কিন্তু উপন্যাসে বিহিত, এমনতরো একটা রব উঠেছে। খাটি হিন্দুয়ানি রক্ষার ভার হিন্দু মেয়েদের উপর কিন্তু হিন্দু পুরুষদের উপর নয়, সমাজে এটা দেখতে পাই। কিন্তু হিন্দুয়ানি যদি সত্য পদার্থই হয় তবে তার ব্যত্যয় মেয়েতেও যেমন দোষাবহ পুরুষেও তেমনি । সাহিত্যনীতিও সেইরকম জিনিস। সর্বত্রই তাকে আপনি সত্য রক্ষা করে চলতে হবে । চরিত্রের প্ৰাণগত রূপ সাহিত্যে আমরা দাবি করবই ; অর্থনীতি সমাজনীতি রাষ্ট্রনীতি চরিত্রের অনুগত হয়ে বিনীতভাবে যদি না আসে, তবে তার বুদ্ধিগত মূল্য যতই থাক, তাকে নিন্দিত করে দূর করতে হবে। নভেলে কোনো-একজন মানুষকে ইনটেলেকচুয়েল প্রমাণ করতে হবে অথবা ইনটেলেকচুয়েলের মনোরঞ্জন করতে হবে বলেই বইখানাকে এম এ পরীক্ষার প্রশ্নোত্তরপত্র করে তোলা চাই, এমন কোনো কথা নেই। গল্পের বইয়ে যাদের থিসিস পড়ার রোগ আছে, আমি বলব, সাহিত্যের পদ্মবনে তঁরা মত্ত হস্তী। কোনো বিশেষ চরিত্রের মানুষ মুসলমানের ঘর থেকে প্রত্যাহৃত স্ত্রীকে আপনি স্বভাব অনুসারে নিতেও পারে, না নিতেও পারে, গল্পের বইয়ে তার নেওয়াটা বা না-নেওয়াটা সত্য হওয়া চাই, কোনো প্রবলেমের দিক থেকে নয়। প্ৰাণের একটা স্বাভাবিক ছন্দোমাত্রা আছে, এই মাত্রার মধ্যেই তার স্বাস্থ্য, সার্থকতা, তার শ্ৰী । এই মাত্রাকে মানুষ জবৰ্দস্তি করে ছাড়িয়ে যেতেও পারে। তাকে বলে পালোয়ানি, .এই পালোয়ানি বিস্ময়কর কিন্তু স্বাস্থ্যকর নয়, সুন্দর তো নয়ই। এই পালোয়ানি সীমােলঙঘন করবার দিকে তাল ঠুকে চলে, দুঃসাধ্য-সাধনও করে থাকে, কিন্তু এক জায়গায় এসে ভেঙে পড়ে। আজ সমস্ত পৃথিবী জুড়ে এই ভাঙনের আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। সভ্যতা স্বভাবকে এত দূরে ছাড়িয়ে গেছে যে কেবলই পদে পদে তাকে সমস্যা ভেঙে ভেঙে চলতে হয়, অর্থাৎ কেবলই সে করছে পালোয়ানি । প্ৰকাণ্ড হয়ে উঠছে তার সমস্ত বোঝা এবং স্তৃপাকার হয়ে পড়ছে তার আবর্জনা। অর্থাৎ মানবের প্রাণের লয়টাকে দানবের লয়ে সাধনা করা চলছে। আজ হঠাৎ দেখা যাচ্ছে কিছুতেই তাল পেঁচাচ্ছে না শমে। এতদিন দুন-চৌদুনের বাহাদুরি নিয়ে চলছিল মানুষ, আজ অন্তত অর্থনীতির দিকে বুঝতে পারছে বাহাদুরিটা সার্থকতা নয়— যন্ত্রের ঘোড়দৌড়ে একটা একটা করে ঘোড়া পড়ছে মুখ থুবড়িয়ে । জীবন এই আর্থিক বাহাদুরির উত্তেজনায় ও অহংকারে এতদিন ভুলে ছিল যে, গতিমাত্রার জটিল অতিকৃতির দ্বারাই জীবনযাত্রার আনন্দকে সে পীড়িত করছে, অসুস্থ হয়ে পড়েছে আধুনিক অতিকায় সংসার, প্ৰাণের ভারসাম্যতত্ত্বকে করেছে অভিভূত । পশ্চিম-মহাদেশের এই কায়াবহুল অসংগত জীবনযাত্রার ধাক্কা লেগেছে সাহিত্যে । কবিতা হয়েছে রক্তহীন, নভেলগুলো উঠেছে বিপরীত মােটা হয়ে। সেখানে তারা সৃষ্টির কাজকে অবজ্ঞা করে