পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ܘܙܥ সাহিত্যে আধুনিকতা সাহিত্যের প্রাণধারা বয় ভাষার নাড়ীতে, তাকে নাড়া দিলে মূল রচনার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়। এরকম সাহিত্যে বিষয়বস্তুটা নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে, যদি তার সজীবতা না থাকে । এবারে আমারই পুরোনো তৰ্জমা ঘাটতে গিয়ে এ কথা বার বার মনে হয়েছে। তুমি বোধ হয় জান, বাছুর মরে গেলে তার অভাবে গাভী যখন দুধ দিতে চায় না। তখন মরা বাছুরের চামড়াটা ছাড়িয়ে নিয়ে তার মধ্যে খড় ভর্তি করে একটা কৃত্রিম মূর্তি তৈরি করা হয়, তারই গন্ধে এবং চেহারার সাদৃশ্যে গভীর স্তনে দুগ্ধ-ক্ষরণ হতে থাকে। তৰ্জমা সেইরকম মরা বাছুরের মূর্তি— তার আহবান নেই, ছলনা আছে। এ নিয়ে আমার মনে লজ্জা ও অনুতাপ জন্মায়। সাহিত্যে আমি যা কাজ করেছি তা যদি ক্ষণিক ও প্ৰাদেশিক না হয় তবে যার গরজ সে যখন হােক আমার ভাষাতেই তার পরিচয় লাভ করবে । পরিচয়ের অন্য কোনো পন্থা নেই। যথাপথে পরিচয়ের যদি বিলম্ব ঘটে। তবে যে বঞ্চিত হয় তারই ক্ষতি, রচয়িতার তাতে কোনো দায়িত্ব নেই । প্ৰত্যেক বড়ো সাহিত্যে দিন ও রাত্রির মতো পর্যায়ক্রমে প্রসারণ ও সংকোচনের দশা ঘটে, মিল্টনের পর ড্রাইডেন-পোপের আবির্ভাব হয় । আমরা প্ৰথম যখন ইংরেজি সাহিত্যের সংস্রবে। আসি তখন সেটা ছিল ওদের প্রসারণের যুগ । যুরোপে। ফরাসিবিপ্লব মানুষের চিত্তকে যে নাড়া দিয়েছিল। সে ছিল বেড়া ভাঙবার নাড়া । এইজন্যে দেখতে দেখতে তখন সাহিত্যের আতিথেয়তা প্ৰকাশ পেয়েছিল বিশ্বজনীনরপে । সে যেন রসসৃষ্টির সার্বজনিক যজ্ঞ । তার মধ্যে সকল দেশেরই আগন্তুক অবাধে আনন্দভোগের অধিকার পায়। আমাদের সৌভাগ্য এই যে, ঠিক সেই সময়েই যুরোপের আহবান আমাদের কানে এসে পৌঁছল- তার মধ্যে ছিল সর্বমানবের মুক্তির বাণী । আমাদের তো সাড়া দিতে দেরি হয় নি। সেই আনন্দে আমাদেরও মনে নবসৃষ্টির প্রেরণা এল। সেই প্রেরণা আমাদেরও জাগ্রত মনকে পথনির্দেশ করলে বিশ্বের দিকে । সহজেই মনে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছিল যে কেবল বিজ্ঞান নয়, সাহিত্যসম্পদও আপনি উদ্ভবস্থানকে অতিক্রম ক’রে সকল দেশ ও সকল কালের দিকে বিস্তারিত হয় ; তার দক্ষিণ্য যদি সীমাবদ্ধ হয়, যদি তাতে আতিথ্যধর্ম না থাকে, তবে স্বদেশের লোকের পক্ষে সে যতই উপভোগ্য হােক-না কেন, সে দরিদ্র । আমরা নিশ্চিত জানি যে, যে ইংরাজি সাহিত্যকে আমরা পেয়েছি সে দরিদ্র নয়, তার সম্পত্তি স্বজাতিক লোহার সিন্ধুকে দলিলবদ্ধ হয়ে নেই। একদা ফরাসিবিপ্লবকে র্যারা ক্ৰমে ক্ৰমে আগিয়ে নিয়ে এসেছিলেন তারা ছিলেন বৈশ্বমানবিক আদর্শের প্রতি বিশ্বাসপরায়ণ ।। ধৰ্মই হােক, রাজশক্তিই হােক, যা-কিছু ক্ষমতালুব্ধ, যা-কিছু ছিল মানুষের মুক্তির অন্তরায়, তারই বিরুদ্ধে ছিল তাদের অভিযান। সেই বিশ্বকল্যাণ-ইচ্ছার আবহাওয়ায় জেগে উঠেছিল যে সাহিত্য সে মহৎ ; সে মুক্তদ্বার-সাহিত্য সকল দেশ সকল কালের মানুষের জন্য : সে এনেছিল আলো, এনেছিল আশা। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানের সাহায্যে যুরোপের বিষয়বুদ্ধি বৈশ্যযুগের অবতারণা করলে। স্বজাতির ও পরজাতির মর্মস্থল বিদীর্ণ করে। ধনস্রোত নানা প্রণালী দিয়ে যুরোপের নবােদ্ভুত ধনিকমণ্ডলীর মধ্যে সঞ্চারিত হতে লাগল। বিষয়বুদ্ধি সর্বত্র সর্ব বিভাগেই ভেদবুদ্ধি, তা ঈৰ্ষাপরায়ণ। স্বার্থসাধনার বাহন যারা তাদেরই ঈর্ষা, তাদেরই ভেদনীতি অনেকদিন থেকেই যুরোপের অন্তরে অন্তরে গুমরে উঠছিল ; সেই বৈনাশিক শক্তি হঠাৎ সকল বাধা বিদীর্ণ করে আগ্নেয়াম্রাবে য়ুরোপকে ভাসিয়ে দিলে। এই যুদ্ধের মূলে ছিল সমাজধ্বংসকারী রিপু, উদার মনুষ্যত্বের প্রতি । অবিশ্বাস। সেইজন্যে এই যুদ্ধের যে দান তা দানবের দান, তার বিষ কিছুতেই মরতে চায় না, তা শান্তি আনলে না । তার পর থেকে যুরোপের চিত্ত কঠোরভাবে সংকুচিত হয়ে আসছে- প্রত্যেক দেশই আপন দরজার আগলের সংখ্যা বাড়াতে ব্যাপৃত। পরম্পরের বিরুদ্ধে যে সংশয়, যে নিষেধ প্রবল হয়ে উঠছে। তার চেয়ে অসভ্যতার লক্ষণ আমি তো আর কিছু দেখি নে। রাষ্ট্ৰতন্ত্রে একদিন আমরা যুরোপকে জনসাধারণের মুক্তিসাধনার তপােভূমি বলেই জানতুম— অকস্মাৎ দেখতে পাই, সমস্ত যাচ্ছে বিপর্যন্ত