পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের স্বরূপ እb”ዒ হয়ে। সেখানে দেশে দেশে জনসাধারণের কণ্ঠে ও হাতে পায়ে শিকুল দৃঢ় হয়ে উঠছে ; হিংস্রতায় যাদের কোনো কুষ্ঠা নেই তারাই রাষ্ট্রনেতা। এর মূলে আছে ভীরুতা, যে ভীরুতা বিষয়বুদ্ধির । ভয়, পাছে ধনের প্রতিযোগিতায় বাধা পড়ে, পাছে অর্থভাণ্ডারে এমন ছিদ্র দেখা দেয় যার মধ্য দিয়ে ক্ষতির দুগ্রহ আপন প্রবেশপথ প্রশস্ত করতে পারে। এইজন্যে বড়ো বড়ো শক্তিমান পাহারাওয়ালদের কাছে দেশের লোক আপনি স্বাধীনতা, আপনি আত্মসম্মান বিকিয়ে দিতে প্ৰস্তুত আছে। এমন-কি, স্বজাতির চিরাগত সংস্কৃতিকে খর্ব হতে দেখেও শাসনতন্ত্রের বর্বরতাকে শিরোধাৰ্য করে নিয়েছে। বৈশ্যযুগের এই ভীরুতায় মানুষের আভিজাত্য নষ্ট করে দেয়, তার ইত্যরতার লক্ষণ নির্লজ্জভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। পণ্যহাটের তীর্থযাত্রী অর্থলুব্ধ যুরোপ এই-যে আপন মনুষ্যত্বের খর্বতা মাথা হেঁট করে স্বীকার করছে, আত্মরক্ষার উপায়রপে নির্মাণ করছে আপনি কারাগার, এর প্রভাব কি ক্রমে ক্রমে তার সাহিত্যকে অধিকার করছে না । ইংরেজি সাহিত্যে একদা আমরা বিদেশীরা যে নিঃসংকোচ আমন্ত্রণ পেয়েছিলুম আজ কি তা আর আছে। এ কথা বলা বাহুল্য, প্রত্যেক দেশের সাহিত্য মুখ্যভাবে আপন পাঠকদের জন্য ; কিন্তু তার মধ্যে সেই স্বাভাবিক দাক্ষিণ্য আমরা প্রত্যাশা করি যাতে সে দূর-নিকটের সকল অতিথিকেই আসন জোগাতে পারে । যে সাহিত্যে সেই আসন প্রসারিত সেই সাহিত্যই মহৎ সাহিত্য, সকল কালেরই মানুষ সেই সাহিত্যের স্থায়িত্বকে সুনিশ্চিত করে তোলে ; তার প্রতিষ্ঠাভিত্তি সর্বমানবের চিত্তক্ষেত্রে । আমাদের সমসাময়িক বিদেশী সাহিত্যকে নিশ্চিত প্রত্যয়ের সঙ্গে বিচার করা নিরাপদ নয়। আধুনিক ইংরেজি সাহিত্য সম্বন্ধে আমি যেটুকু অনুভব করি সে আমার সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতা থেকে, তার অনেকখানিই হয়তো অজ্ঞতা। এ সাহিত্যের অনেক অংশের সাহিত্যিক মূল্য হয়তো যথেষ্ট আছে, কালে কালে তার যাচাই হতে থাকবে । আমি যা বলতে পারি তা আমার ব্যক্তিগত বোধশক্তির সীমানা থাকে । আমি বিদেশীর তরফ থেকে বলছি- অথবা তাও নয়, একজনমাত্র বিদেশী কবির তরফ থেকে বলছি— আধুনিক ইংরেজি কাব্যসাহিত্যে আমার প্রবেশাধিকার অত্যন্ত বাধাগ্ৰস্ত। আমার এ কথার যদি কোনো ব্যাপক মূল্য থাকে তবে এই প্রমাণ হবে যে, এই সাহিত্যের অন্য নানা গুণ থাকতে পারে। কিন্তু একটা গুণের অভাব আছে যাকে বলা যায়। সার্বভৌমিকতা, যাতে ক’রে বিদেশ থেকে আমিও একে অকুষ্ঠিতচিত্তে মেনে নিতে পারি। ইংরেজের প্রাক্তন সাহিত্যকে তো আনন্দের সঙ্গে মেনে নিয়েছি, তার থেকে কেবল যে রস পেয়েছি তা নয়, জীবনের যাত্রাপথে আলো পেয়েছি। তার প্রভাব আজও তো মন থেকে দূর হয় নি। আজ দ্বাররুদ্ধ যুরোপের দুর্গমতা অনুভব করছি আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যে । তার কঠোরতা আমার কাছে অনুদার বলে ঠেকে। বিদ্যুপপরায়ণ বিশ্বাসহীনতার কঠিন জমিতে তার উৎপত্তি ; তার মধ্যে এমন উদ্যুবৃত্ত দেখা যাচ্ছে না ঘরের বাইরে যার অকৃপণ আহবান । এ সাহিত্য বিশ্ব থেকে আপনি হৃদয় প্রত্যাহরণ করে নিয়েছে ; এর কাছে এমন বাণী পাই নে যা শুনে মনে করতে পারি যেন আমারই বাণী পাওয়া গেল চিরকালীন দৈববাণীরূপে । দুই-একটি ব্যতিক্রম যে নেই তা বললে অন্যায় হবে । আমাদের দেশের তরুণদের মধ্যে কাউকে কাউকে দেখেছি। যারা আধুনিক ইংরেজি কাব্য কেবল যে বোঝেন তা নয়, সম্ভোগও করেন। তারা আমার চেয়ে আধুনিক কালের অধিকতর নিকটবতী বলেই যুরোপের আধুনিক সাহিত্য হয়তো তাদের কাছে দূরবতী নয়। সেইজন্য তাদের সাক্ষ্যকে আমি মূল্যবান বলেই শ্রদ্ধা করি। কেবল একটা সংশয় মন থেকে যায় না। নূতন যখন পূর্ববতী পুরাতনকে উদ্ধতভাবে উপেক্ষা ও প্রতিবাদ করে তখন দুঃসাহসিক তরুণের মন তাকে যে বাহবা দেয় সকল সময়ে তার মধ্যে নিত্যসত্যের প্রামাণিকতা মেলে না। নূতনের বিদ্রোহ অনেক সময় একটা স্পর্ধমাত্র। আমি এই বলি, বিজ্ঞানে মানুষের কাছে প্রাকৃতিক সত্য আপন নূতন নূতন জ্ঞানের ভিত্তি অবারিত করে, কিন্তু মানুষের আনন্দলোক যুগে যুগে আপন সীমানা বিস্তার করতে পারে। কিন্তু ভিত্তি বদল করে না। যে সৌন্দর্য, যে প্ৰেম, যে মহত্ত্বে মানুষ চিরদিন স্বভাবতই উদবোধিত হয়েছে তার তো বয়সের সীমা নেই ; কোনো আইনস্টাইন এসে তাকে তো অপ্রতিপন্ন করতে পারে না, বলতে পারে না