পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sbrbr রবীন্দ্র-রচনাবলী ‘বসন্তের পুষ্পোচ্ছাসে যার অকৃত্ৰিম আনন্দ সে সেকেলে ফিলিস্টাইন" । যদি কোনো বিশেষ যুগের মানুষ এমন সৃষ্টিছাড়া কথা বলতে পারে, যদি সুন্দরকে বিদ্রুপ করতে তার ওষ্ঠাধর কুটিল হয়ে ওঠে যদি পূজনীয়কে অপমানিত করতে তার উৎসাহ উগ্র হতে থাকে, তা হলে বলতেই হবে, এই মনােভাব চিরন্তন মানবস্বভাবের বিরুদ্ধ। সাহিত্য সর্ব দেশে এই কথাই প্রমাণ করে আসছে যে, মানুষের আনন্দনিকেতন চিরপুরাতন । কালিদাসের মেঘদূতে মানুষ আপন চিরপুরাতন বিরহ-বেদনারই স্বাদ পেয়ে আনন্দিত। সেই চিরপুরাতনের চিরনূতনত্ব বহন করছে মানুষের সাহিত্য, মানুষের শিল্পকলা। এইজন্যেই মানুষের সাহিত্য, মানুষের শিল্পকলা সর্বমানবের । তাই বারে বারে এই কথা আমার মনে হয়েছে, বর্তমান ইংরেজি কাব্য উদ্ধতভাবে নূতন, পুরাতনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী-ভাবে নূতন । যে তরুণের মন কালাপাহাড়ি সে এর নব্যতার মদির রসে মত্ত, কিন্তু এই নব্যতাই এর ক্ষণিকতার লক্ষণ । যে নবীনতাকে অভ্যর্থনা করে বলতে পারি নে জনম অবধি হম রূপ নেহারানু নয়ন ন তিরপিত ভেল, লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখানু তবু হিয়া জুড়ন ন গেলতাকে যেন সত্যই নূতন ব'লে ভ্ৰম না করি, সে আপনি সদ্যজন্মমুহূর্তে আপনই জর সঙ্গে নিয়ে এসেছে, তার আয়ুঃস্থানে যে শনি সে যত উজ্জ্বলাই হােক তবু সে শনিই বটে। N. SO8S কাব্য ও ছন্দ গদ্যকাব্য নিয়ে সন্ধিগ্ধ পাঠকের মনে তর্ক চলছে। এতে আশ্চর্যের বিষয় নেই। ছন্দের মধ্যে যে বেগ আছে সেই বেগের অভিঘাতে রসগৰ্ভ বাক্য সহজে হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করে, মনকে দুলিয়ে তোলে- এ কথা স্বীকার করতে হবে। শুধু তাই নয় । যে সংসারের ব্যবহারে গদ্য নানা বিভাগে নানা কাজে খেটে মরছে। কাব্যের জগৎ তার থেকে পৃথক। পদ্যের ভাষাবিশিষ্টতা এই কথাটাকে স্পষ্ট করে ; স্পষ্ট হলেই মনটা তাকে স্বাক্ষত্রে অভ্যর্থনা করবার জন্যে প্রস্তুত হতে পারে । গেরুয়াবেশে সন্ন্যাসী জানান দেয়, সে গৃহীর থেকে পৃথক ; ভক্তের মন সেই মুহুর্তেই তার পায়ের কাছে এগিয়ে আসে— নইলে সন্ন্যাসীর ভক্তির ব্যবসায়ে ক্ষতি হবার কথা । কিন্তু বলা বাহুল্য, সন্ন্যাসধর্মের মুখ্য তত্ত্বটা তার গেরুয়া কাপড়ে নয়, সেটা আছে তার সাধনার সত্যতায় । এই কথাটা যে বোঝে, গেরুয়া কাপড়ের অভাবেই তার মন আরো বেশি করে আকৃষ্ট হয়। সে বলে, আমার বোধশক্তির দ্বারাই সত্যকে চিনিব সেই গেরুয়া কাপড়ের দ্বারা নয়- যে কাপড়ে বহু অসত্যকে চাপা দিয়ে রাখে । ছন্দটাই যে ঐকান্তিকভাবে কাব্য তা নয়। কাব্যের মূল কথাটা আছে। রসে ; ছন্দটা এই রসের পরিচয় দেয় আনুষঙ্গিক হয়ে । সহায়তা করে দুই দিক থেকে। এক হচ্ছে, স্বভাবতই তার দােলা দেবার শক্তি আছে ; আর-এক | হচ্ছে, পাঠকের চিরাভ্যস্ত সংস্কার । এই সংস্কারের কথাটা ভাববার বিষয় । একদা নিয়মিত অংশে বিভক্ত ছন্দই সাধু কাব্যভাষায় একমাত্র পাংক্তেয় বলে গণ্য ছিল। সেই সময়ে আমাদের কানের অভ্যাসও ছিল তার অনুকূলে। তখন ছন্দে মিল রাখাও ছিল অপরিহার্য। এমন সময়ে মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে আমাদের সংস্কারের প্রতিকূলে আনলেন অমিত্ৰাক্ষর ছন্দ । তাতে রইল না মিল। তাতে লাইনের বেড়াগুলি সমান ভাগে সাজানাে বটে, কিন্তু ছন্দের পদক্ষেপ