পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sd NR রবীন্দ্র-রচনাবলী থাকতে পারে না । কোমলে কঠিনে মিলে একটা সংযত রীতির আপনা-আপনি উদ্ভব হয় । নটীর নাচে শিক্ষিতাপটু অলংকৃত পদক্ষেপ। অপর পক্ষে, ভালো চলে এমন কোনো তরুণীর চলনে ওজন-রক্ষার একটি স্বাভাবিক নিয়ম আছে। এই সহজ সুন্দর চলার ভঙ্গিতে একটা অশিক্ষিত ছন্দ আছে, যে ছন্দ তার রক্তের মধ্যে, যে ছন্দ তার দেহে। গদ্যকাব্যের চলন হল সেইরকম— অনিয়মিত উদ্ধৃঙ্খল গতি নয়, সংযত পদক্ষেপ । আজকেই মোহাম্মদী পত্রিকায় দেখছিলুম কে-একজন লিখেছেন যে, রবিঠাকুরের গদ্যকবিতার রস তিনি তার সাদা গদ্যেই পেয়েছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ লেখক বলেছেন যে “শেষের কবিতায় মূলত কাব্যরসে অভিষিক্ত জিনিস এসে গেছে । তাই যদি হয় তবে কি জেনানা থেকে বার হবার জন্যে কাব্যের জাত গেল। এখানে আমার প্রশ্ন এই, আমরা কি এমন কাব্য পড়ি নি যা গদ্যের বক্তব্য বলেছে, যেমন ধরুন ব্রাউনিঙে । আবার ধরুন, এমন গদ্যও কি পড়ি নি। যার মাঝখানে কবিকল্পনার রেশ পাওয়া গেছে। গদ্য ও পদ্যের ভাশুর-ভাদ্ররউ সম্পর্ক আমি মানি না । আমার কাছে তারা ভাই আর বোনের মতো, তাই যখন দেখি গদ্যে পদ্যের রস ও পদ্যে গদ্যের গাম্ভীর্যের সহজ আদানপ্ৰদান হচ্ছে তখন আমি আপত্তি করি নে । রুচিভেদ নিয়ে তর্ক করে কিছু লাভ হয় না। এইমাত্রই বলতে পারি, আমি অনেক গদ্যকাব্য লিখেছি। যার বিষয়বস্তু অপর কোনো রূপে প্রকাশ করতে পারতুম না । তাদের মধ্যে একটা সহজ প্ৰত্যহিক ভাব আছে ; হয়তো সজা নেই। কিন্তু রূপ আছে এবং এইজন্যেই তাদেরকে সত্যকার কাব্যগোত্রীয় বলে মনে করি । কথা উঠতে পারে, গদ্যকাব্য কী । আমি বলব, কী ও কেমন জানি না, জানি যে এর কাব্যরস এমন একটা জিনিস যা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করবার নয়। যা আমাকে বচনাতীতের আস্বাদ দেয় তা গদ্য বা পদ্য রূপেই আসুক, তাকে কাব্য বলে গ্রহণ করতে পরাভূখ হব न् | শাস্তিনিকেতন । ২৯ আগস্ট, ১৯৩৯ SVO8V সাহিত্যবিচার সূক্ষ্মদৃষ্টি জিনিসটা যে রস আহরণ করে সেটা সকল সময় সার্বজনিক হয় না। সাহিত্যের এটাই হল অপরিহার্য দৈন্য । তাকে পুরস্কারের জন্য নির্ভর করতে হয় ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধির উপরে। তার নির্ম-আদালতে বিচার সেও যেমন বৈজ্ঞানিক বিধি-নির্দিষ্ট নয়, তার আপিল-আদালতের রায়ও তথৈবচ। এ স্থলে আমাদের প্রধান নির্ভরের বিষয় বহুসংখ্যক শিক্ষিত রুচির অনুমোদনে । কিন্তু কে না জানে যে, শিক্ষিত লোকের রুচির পরিধি তৎকালীন বেষ্টনীর দ্বারা সীমাবদ্ধ, সময়ান্তরে তার দশান্তর ঘটে। সাহিত্যবিচারের মাপকাঠি একটা সজীব পদার্থ। কালক্রমে সেটা বাড়ে এবং কমে, কৃশ হয় এবং স্কুল হয়েও থাকে। তার সেই নিত্যপরিবর্তমান পরিমাণবৈচিত্র্য দিয়েই সে সাহিত্যকে বিচার করতে বাধ্য, আর-কোনো উপায় নেই। কিন্তু বিচারকেরা সেই হ্রাসবৃদ্ধিকে অনিত্য বলে স্বীকার করেন না ; র্তারা বৈজ্ঞানিক ভঙ্গি নিয়ে নির্বিকার অবিচলতার ভান করে থাকেন ; কিন্তু এ বিজ্ঞান মেকি বিজ্ঞান, খাটি নয়- ঘরগড়া বিজ্ঞান, শাশ্বত নয় । উপস্থিতমত যখন একজন বা এক সম্প্রদায়ের লোক সাহিত্যিকের উপরে কোনো মত জাহির করেন তখন সেই ক্ষণিক চলমান আদর্শের অনুসারে সাহিত্যিকের দণ্ড-পুরস্কারের ভাগ-বাটােয়ারা হয়ে থাকে । তার বড়ো আদালত নেই ; তার ফাঁসির দণ্ড হলেও সে একান্ত মনে আশা করে যে, বেঁচে থাকতে থাকতে হয়তো ফাস যাবে ছিড়ে ; গ্রহের গতিকে কখনাে যায়, কখনাে যায় না। সমালোচনার এই অধ্রুব অনিশ্চয়তা থেকে স্বয়ং শেক্সপীয়রও নিষ্কৃতি