পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের স্বরূপ SV) লাভ করেন নি। পণ্যের মূল্যনির্ধারণকালে ঝগড়া করে তর্ক করে, কিংবা আর পাঁচজনের নজির তুলে তার সমর্থন করা জলের উপর ভিত গড়া । জল তো স্থির নয়, মানুষের রুচি স্থির নয়, কাল স্থির নয় । এ স্থলে ধ্রুব আদর্শের ভান না করে সাহিত্যের পরিমাপ যদি সাহিত্য দিয়েই করা যায় তা হলে শান্তি রক্ষা হয় । অর্থাৎ জজের রায় স্বয়ং যদি শিল্পনিপুণ হয় তা হলে মানদণ্ডই সাহিত্যভাণ্ডারে সসম্মানে রক্ষিত হবার যোগ্য হতে পারে । - সাহিত্যবিচারমূলক গ্ৰন্থ পড়বার সময় প্রায়ই কমবেশি পরিমাণে যে জিনিসটি চােখে পড়ে সে হচ্ছে বিচারকের বিশেষ সংস্কার ; এই সংস্কারের প্রবর্তন ঘটে তার দলের সংস্রবে, তার শ্রেণীর টানে, তার শিক্ষার বিশেষত্ব নিয়ে। কেউ এ প্রভাব সম্পূর্ণ এড়াতে পারেন না। বলা বাহুল্য, এ সংস্কার জিনিসটা সৰ্বকালের আদর্শের নির্বিশেষ অনুবতী নয় । জজের মনে ব্যক্তিগত সংস্কার থাকেই, কিন্তু তিনি আইনের দণ্ডের সাহায্যে নিজেকে খাড়া রাখেন। দুৰ্ভাগ্যক্রমে সাহিত্যে এই আইন তৈরি হতে থাকে বিশেষ কালের বা বিশেষ দলের, বিশেষ শিক্ষার বা বিশেষ ব্যক্তির তাড়নায় । এ আইন সর্বজনীন এবং সৰ্বকালের হতে পারে না। সেইজন্যেই পাঠক-সমাজে বিশেষ বিশেষ কালে এক-একটা বিশেষ মরসুম দেখা দেয়, যথা টেনিসনের মরসুম, কিপলিঙের মরসুম। এমন নয় যে, ক্ষুদ্র একটা দলের মনেই সেটা ধাক্কা মারে, বৃহৎ জনসংঘ এই মরসুমের দ্বারা চালিত হতে থাকে, অবশেষে কখন একসময় ঋতুপরিবর্তন হয়ে যায়। বেজ্ঞানিক সত্যবিচারে এরকম ব্যক্তিগত পক্ষপাতিত্ব কেউ প্রশ্রয় দেয় না । এই বিচারে আপনি বিশেষ সংস্কারের দোহাই দেওয়াকে বিজ্ঞানে মূঢ়তা বলে। অথচ সাহিত্যে এই ব্যক্তিগত ছোয়াচ লাগাকে কেউ তেমন নিন্দ করে না । সাহিত্যে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, সেটা অধিকাংশ স্থলেই যোগ্য বা অযোগ্য বিচারকের বা তার সম্প্রদায়ের আশ্ৰয় নিয়ে আপনাকে ঘোষণা করে । বর্তমানকালে বিত্তাল্পতার মমত্ব বা তুমহংকার সর্বজনীন আদর্শের ভান করে দণ্ডনীতি প্রবর্তন করতে চেষ্টা করছে। এও যে অনেকটা বিদেশী নকলের ছোয়াচ লাগা মরসুম হতে পারে, পক্ষপাতী লোকে এটা স্বীকার করতে পারেন না । সাহিত্যে এইরকম বিচারকের অহংকার ছাপার অক্ষরের বত্রিশ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। অবশ্য যারা শ্রেণীগত বা দলগত বা বিশেষকালগত মমত্বের দ্বারা সম্পূর্ণ অভিভূত নয়, তাদের বুদ্ধি অপেক্ষাকৃত নিরাসক্ত। কিন্তু তারা যে কে তা কে স্থির করবে, যে সর্ষে দিয়ে ভূত ঝাড়ায় সেই সর্ষেকেই ভূতে পায়। আমরা বিচারকের শ্রেষ্ঠতা নিরূপণ করি নিজের মতের শ্রেষ্ঠতার অভিমানে । মোটের উপর নিরাপদ হচ্ছে ভান না করা, সাহিত্যের সমালোচনাকেই সাহিত্য করে তোলা । সেরকম সাহিত্য মতের একান্ত সত্যতা নিয়ে চরম মূল্য পায় না। তার মূল্য তার সাহিত্যরসেই। সমালোচকদের লেখায় কটাক্ষে এমন আভাস পেয়ে থাকি, যেন আমি, অন্তত কোথাও কোথাও, আধুনিক পদক্ষেপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবার কাচা চেষ্টা করছি এবং সেটা আমার কাব্যের স্বভাবের সঙ্গে মিশ খাচ্ছে না । এই উপলক্ষে এ সম্বন্ধে আমার বক্তব্যটা বলে নিই। আমার মনে আছে, যখন আমি ‘ক্ষণিকা’ লিখেছিলেম। তখন একদল পাঠকের ধাধা লেগেছিল। তখন যদি আধুনিকের রেওয়াজ থাকত তা হলে কারও বলতে বাধত না যে, ঐ-সব লেখায় আমি আধুনিকের সাজ পরতে শুরু করেছি। মানুষের বিচারবুদ্ধির ঘাড়ে তার ভূতগত সংস্কার চেপে বসে। জিনিস। তঁর মতে সেটা হতে বাধ্য, কেননা লিরিক-কবিদের মধ্যে স্বভাবতই হাস্যরসের অভাব থাকে। তৎসত্ত্বেও আমার ‘চিরকুমারসভা ও অন্যান্য প্রহসনের উল্লেখ তাকে করতে হয়েছে, কিন্তু তীর মতে তার হাস্যরসটা অগভীর, কারণ- কারণ আর কিছু বলতে হবে না, কারণ র্তার সংস্কার, যে সংস্কার যুক্তিতর্কের অতীত।-- আমি অনেক সময় খুঁজি সাহিত্যে কার হাতে কর্ণধারের কাজ দেওয়া যেতে পারে, অর্থাৎকার হাল ডাইনে-বায়ের ঢেউয়ে দোলাদুলি করে না। একজনের নাম খুব বড়ো করে আমার মনে পড়ে, তিনি হচ্ছেন প্রমথ চৌধুরী। প্রমথর নাম আমার বিশেষ করে মনে আসবার কারণ এই যে, আমি তার কাছে