পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

NS o রবীন্দ্র-রচনাবলী করে রেখেছিল। স্থানে স্থানে লোকমান্য তিলকের মতো জনকতক সাহসী পুরুষ জড়তত্ত্বকে প্ৰাণপণে আঘাত করেছেন, এবং আত্মশ্রদ্ধার আদর্শকে জাগিয়ে তোলবার কাজে ব্ৰতী হয়েছেন, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এই আদর্শকে বিপুল ভাবে প্রবল প্রভাবে প্রয়োগ করলেন মহাত্মা গান্ধী। ভারতবর্ষের স্বকীয় প্রতিভাকে অন্তরে উপলব্ধি করে তিনি অসামান্য তপস্যার তেজে নূতন যুগগঠনের কাজে নামলেন। আমাদের দেশে আত্মপ্রকাশের ভয়হীন অভিধান এতদিনে যথোপযুক্ত রূপে আরম্ভ হল। এত কাল আমাদের নিঃসাহসের উপরে দুর্গ বেঁধে বিদেশী বণিকরােজ সাম্রাজ্যিকতার ব্যাবসা চালিয়েছে। অস্ত্রশস্ত্র সৈন্যসামন্ত ভালো করে দাড়াবার জায়গা পেত না যদি আমাদের দুর্বলতা তাকে আশ্রয় না দিত। পরাভাবের সবচেয়ে বড়ো উপাদান আমরা নিজের ভিতর থেকেই জুগিয়েছি। এই আমাদের আত্মকৃত পরাভব থেকে মুক্তি দিলেন মহাত্মজি ; নববীর্যের অনুভূতির বন্যাধারা ভারতবর্ষে প্রবাহিত করলেন। এখন শাসনকর্তারা উদ্যত হয়েছেন আমাদের সঙ্গে রফানিস্পত্তি করতে ; কেননা তাদের পরশাসনতন্ত্রের গভীরতর ভিত্তি টলেছে, যে ভিত্তি আমাদের বীর্যহীনতায় । আমরা অনায়াসে আজ জগৎসমাজে আমাদের স্থান দাবি করছি । তাই আজ আমাদের জানতে হবে, যে মানুষ বিলেতে গিয়ে রাউন্ড টেবল কনফারেন্সে তর্কযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, যিনি খদ্দর চরকা প্রচার করেন, যিনি প্ৰচলিত চিকিৎসাশাস্ত্ৰে বৈজ্ঞানিক-যন্ত্রপাতিতে বিশ্বাস করেন বা করেন না- এই সব মতামত ও কর্মপ্রণালীর মধ্যে যেন এই মহাপুরুষকে সীমাবদ্ধ করে না দেখি । সাময়িক যে-সব ব্যাপারে তিনি জড়িত তাতে তার ত্রুটিও ঘটতে পারে, তা নিয়ে তর্কও চলতে পারে- কিন্তু এহি বাহ্য । তিনি নিজে বারংবার স্বীকার করেছেন, তার ভ্ৰান্তি হয়েছে ; কালের পরিবর্তনে তাকে মত বদলাতে হয়েছে। কিন্তু এই-যে অবিচলিত নিষ্ঠ যা তার সমস্ত জীবনকে অচলপ্রতিষ্ঠা করে তুলেছে, এই-যে অপরাজেয় সংকল্পশক্তি, এ তার সহজাত, কর্ণের সহজাত কবচোর মতো- এই শক্তির প্রকাশ মানুষের ইতিহাসে চিরস্থায়ী সম্পদ। প্রয়োজনের সংসারে নিত্যপরিবর্তনের ধারা বয়ে চলেছে, কিন্তু সকল প্রয়োজনকে অতিক্রম করে যে মহাজীবনের মহিমা আজ আমাদের কাছে উদঘাটিত হল তাকেই যেন আমরা শ্রদ্ধা করতে শিখি । মহাত্মজির জীবনের এই তেজ আজি সমগ্র দেশে সঞ্চারিত হয়েছে, আমাদের স্নানতা মার্জনা করে দিচ্ছে। তার এই তেজোদীপ্ত সাধকের মূর্তিই মহাকালের আসনকে অধিকার করে আছেন। বাধা-বিপত্তিকে তিনি মানেন নি, নিজের ভ্ৰমে ঠাকে খর্ব করে নি, সাময়িক উত্তেজনার ভিতরে থেকেও তার উর্ধে তার মন অপ্ৰমত্ত। এই বিপুল চরিত্ৰশক্তির আধার যিনি তাকেই আজ তার জন্মদিনে আমরা নমস্কার করি । পরিশেষে আমার বলবার কথা এই যে, পূর্বপুরুষের পুনরাবৃত্তি করা মনুষ্যধৰ্ম নয়। জীবজন্তু তাদের জীর্ণ অভ্যাসের বাসাকে আঁকড়ে ধরে থাকে ; মানুষ যুগে যুগে নব নব সৃষ্টিতে আত্মপ্রকাশ করে, পুরাতন সংস্কারে কোনোদিন তাকে বেঁধে রাখতে পারে না। মহাত্মজি ভারতবর্ষের বহুযুগব্যাপী অন্ধতা মূঢ় আচারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ এক দিক থেকে জাগিয়ে তুলেছেন, আমাদের সাধনা হােক সকল দিক থেকেই তাকে প্রবল করে তোলা। জাতিভেদ, ধর্মবিরোধ, মূঢ় সংস্কারের আবর্তে যত দিন আমরা চালিত হতে থাকিব ততদিন কার সাধ্য আমাদের মুক্তি দেয়। কেবল ভোটের সংখ্যা এবং পরস্পরের স্বত্বের চুলচেরা হিসােব গণনা করে কোনো জাত দুৰ্গতি থেকে উদ্ধার পায় না। যে জাতির সামাজিক ভিত্তি বাধায় বিরোধে শতছিদ্র হয়ে আছে, যারা পঞ্জিকায় বুড়ি ঝুড়ি আবর্জনা বহন করে বেড়ায়, বিচারশক্তিহীন মূঢ় চিত্তে বিশেষ ক্ষণের বিশেষ জলে পুরুষানুক্রমিক পাপক্ষালন করতে ছোটে, যারা আত্মবুদ্ধি-আত্মশক্তির অবমাননাকে আপ্তবাক্যের নাম দিয়ে আদরে পোষণ করছে, তারা কখনো এমন সাধনাকে স্থায়ী ও গভীর ভাবে বহন করতে পারে না যে সাধনায় অন্তরে বাহিরে পরিদাসত্বের বন্ধন ছেদন করতে পারে, যার দ্বারা স্বাধীনতার দুরূহ দায়িত্বকে সকল শত্রুর হাত থেকে দৃঢ় শক্তিকে রক্ষা করতে পারে । মনে রাখা চাই, বাহিরের শত্রুর সঙ্গে সংগ্ৰাম করতে তেমন বীর্যের দরকার হয় না, আপন অন্তরের শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করাতেই মনুষ্যত্বের চরম পরীক্ষা। আজ র্যাকে আমরা শ্ৰদ্ধা করছি