পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মহাত্মা গান্ধী S: Gł খৃস্টানশাস্ত্রে পড়েছি, আচারনিষ্ঠ য়িহুদিরা যিশুখৃস্টকে শত্রু বলে মেরেছিল। কিন্তু মাির কি শুধু দেহের । যিনি প্ৰাণ দিয়ে কল্যাণের পথ খুলে দিতে আসেন, সেই পথকে বাধাগ্ৰস্ত করা সেও কি মার নয়। সকলের চেয়ে বড়ো মার সেই। কী অসহ্য বেদনা অনুভব করে তিনি আজকের দিনে মৃত্যুব্রত গ্ৰহণ করেছেন। সেই ব্ৰতকে যদি আমরা স্বীকার করে না নিই, তবে কি তাকে আমরা মারলুম না। আমাদের ছোটাে মনের সংকোচ, ভীরুতা, আজ লজ্জা পাবে না ? আমরা কি তার সেই বেদনাকে মর্মের মধ্যে ঠিক জায়গায় অনুভব করতে পারব না । গ্ৰহণ করতে পারব না। তার দান ? এত সংকোচ, এত ভীরুতা আমাদের ? সে ভীরুতার দৃষ্টান্ত তো তার মধ্যে কোথাও নেই। সাহসের অন্ত নেই তার ; মৃত্যুকে তিনি তুচ্ছ করেছেন । কঠিন কারাগার, তার সমস্ত লোহার শিকল নিয়ে তঁর ইচ্ছাকে ঠেকাতে পারে নি। সেই তিনি এসেছেন আজ আমাদের মাঝখানে । আমরা যদি ভয়ে পিছিয়ে পড়ি, তবে লজ্জা রাখবার ঠাই থাকবে না । তিনি আজ মৃত্যুব্রত গ্ৰহণ করেছেন ছোটাে-বড়োকে এক করবার জন্যে । তার সেই সাহস, তার সেই শক্তি, আসুক আমাদের বুদ্ধিতে, আমাদের কাজে । আমরা যেন আজ গলা ছেড়ে বলতে পারি, “তুমি যেয়ে না, আমরা গ্ৰহণ করলাম তোমার ব্ৰত ।” তা যদি না পারি, এত বড়ো জীবনকে যদি ব্যর্থ হতে দিই, তবে তার চেয়ে বড়ো সর্বনাশ আর কী হতে পারে। আমরা এই কথাই বলে থাকি যে, বিদেশীরা আমাদের শক্ৰতা করছে ; কিন্তু তার চেয়ে বড়ো শত্ৰু আছে আমাদের মজার মধ্যে, সে আমাদের ভীরুতা। সেই ভীরুতাকে জয় করার জন্যে বিধাতা আমাদের শক্তি পাঠিয়ে দিয়েছেন তার জীবনের মধ্য দিয়ে ; তিনি আপনি অভয় দিয়ে আমাদের ভয় হরণ করতে এসেছেন। সেই তার দান-সুদ্ধ তাকে আজ কি আমরা ফিরিয়ে দেব। এই কীেপীনধারী আমাদের দ্বারে দ্বারে আঘাত করে ফিরেছেন, তিনি আমাদের সাবধান করেছেন কোনখানে আমাদের বিপদ।। মানুষ যেখানে মানুষের অপমান করে, মানুষের ভগবান সেইখানেই বিমুখ। শত শত বছর ধরে মানুষের প্রতি অপমানের বিষ আমরা বইয়ে দিয়েছি। ভারতবর্ষের নাড়ীতে নাড়ীতে । হীনতার অসহ্য বোঝা চাপিয়ে দিয়েছি শত শত নত মস্তকের উপরে ; তারই ভারে সমস্ত দেশ আজ ক্লান্ত, দুর্বল। সেই পাপে সোজা হয়ে দাড়াতে পারছি নে। আমাদের চলাবার রাস্তায় পদে পদে পঙ্ককুণ্ড তৈরি করে রেখেছি ; আমাদের সৌভাগ্যের অনেকখানি তলিয়ে যাচ্ছে তারই মধ্যে । এক ভাই আর-এক ভাইয়ের কপালে স্বহস্তে কলঙ্ক লেপে দিয়েছে, মহাত্মা সইতে পারেন নি এই পাপ । সমস্ত অন্তঃকরণ দিয়ে শোনো তার বাণী । অনুভব করো, কী প্ৰচণ্ড তার সংকল্পের জোর । আজ তপস্বী উপবাস আরম্ভ করেছেন, দিনের পর দিন তিনি অন্ন নেবেন না । তোমরা দেবে না। তাকে অন্ন ? তীর বাণীকে গ্ৰহণ করাই তার অন্ন, তাই দিয়ে তাকে বাচাতে হবে । অপরাধ অনেক করেছি, পাপ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে। ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবহার করেছি। দাসের মতো, পশুর মতো। সেই অপমানে সমস্ত পৃথিবীর কাছে ছােটাে করে রেখেছে আমাদের। যদি তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতাম তা হলে আজ এত দুৰ্গতি হত না আমাদের। পৃথিবীর অন্য সব সমাজকে লোকে সম্মান করে, ভয় করে, কেননা তারা পরস্পর ঐক্যবন্ধনে বদ্ধ। আমাদের এই হিন্দুসমাজকে আঘাত করতে, অপমান করতে, কারও རྒྱུ་ নেই, বার বার তার প্রমাণ পাই। কিসের জোরে তাদের এই স্পর্ধা। সে কথাটা যেন এক মুহূর্ত না। যে সম্মান মহাত্মাজি সবাইকে দিতে চেয়েছেন, সে সম্মান আমরা সকলকে দেব। যে পারবে না দিতে, ধিক তাকে । ভাইকে ভাই বলে গ্ৰহণ করতে বাধা দেয় যে সমাজ, ধিক সেই জীর্ণ সমাজকে । সব চেয়ে বড়ো ভীরুতা তখনই প্ৰকাশ পায় যখন সত্যকে চিনতে পেরেও মানতে পারি নে। সে ভীরুতার ক্ষমা নেই। অভিশাপ অনেকদিন থেকে আছে দেশের উপর। সেইজন্যে প্রায়শ্চিত্ত করতে বসেছেন একজন। সেই প্ৰায়শ্চিত্তে সকলকে মিলতে হবে, সেই মিলনেই আমাদের চিরমিলন শুরু হবে। মৃত্যুর বৃহৎ পাত্রে তীর প্রায়শ্চিত্ত তিনি আমাদের সকলের সামনে ধরলেন, এগিয়ে দিলেন আমাদের হাতের কাছে । গ্রহণ করো সকলে, ক্ষালন করো পাপ । মঙ্গল হবে । তার শেষ কথা আজ আমি তোমাদের