পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SSbr রবীন্দ্র-রচনাবলী থাকা সত্ত্বেও মতটাকে রক্ষা করবার চেষ্টা করতে গেলে কর্মকর্তর আত্মরক্ষা অসাধ্য হয়ে ওঠে, এই কথাটা অনেকদিন পর্যন্ত বহু দুঃখে আমার দ্বারা পরীক্ষিত হয়েছে। আমার সুযোগ হয়েছিল এই যে, ব্ৰহ্মবান্ধব এবং তার খৃস্টান শিষ্য রেবার্টাব্দ ছিলেন সন্ন্যাসী । এই কারণে অধ্যাপনার আর্থিক ও কর্ম-ভার লঘু হয়েছিল তাদের দ্বারা। এই প্রসঙ্গে আর-একজনের কথা সর্বাপেক্ষা আমার মনে জাগছে, তার কথা কোনোদিন ভুলতে পারি নে। গোড়া থেকে বলা যাক । এই সময়ে দুটি তরুণ যুবক, তাদের বালক বললেই হয়, এসে পড়লেন আমার কাছে। অজিতকুমার চক্রবর্তী তার বন্ধু কবি সতীশচন্দ্র রায়কে নিয়ে এলেন আমাদের জোড়ার্সাকো বাড়িতে, আমার একতলার বসবার ঘরে । সতীশের বয়স তখন উনিশ, বি. এ. পরীক্ষা তার আসন্ন। তার পূর্বে তার একটি কবিতার খাতা অজিত আমাকে পড়বার জন্যে দিয়েছিলেন । পাতায় পাতায় খোলসা করেই জানাতে হয়েছে আমার মত। সব কথা অনুকুল ছিল না। আর-কেউ হলে এমন বিস্তারিত বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হতুম না। সতীশের লেখা পড়ে বুঝেছিলুম তার অল্প বয়সের রচনায় অসামান্যতা অনুজ্বলভাবে প্রচ্ছন্ন। যার ক্ষমতা নিঃসন্ধিগ্ধ, দুটাে একটা মিষ্ট কথায় তাকে বিদায় করা তার অসম্মাননা। আমার মতের যে অংশ ছিল অপ্রিয় অজিত তাতে অসহিষ্ণু হয়েছিলেন, কিন্তু সীেম্যমূর্তি সতীশ স্বীকার করে নিয়েছিলেন প্ৰসন্নভাবে । আমার মনের মধ্যে তখন আশ্রমের সংকল্পটা সব সময়েই ছিল মুখর হয়ে । কথাপ্রসঙ্গে তার একটা ভবিষ্যৎ ছবি আমি ঐদের সামনে উৎসাহের সঙ্গে উজ্জ্বল করে ধরেছিলুম। দীপ্তি দেখা দিল সতীশের মুখে। আমি তাকে আহবান করি নি আমার কাজে । আমি জানতুম তার সামনে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরের দুই বড়ো ধাপ বাকি। তার শেষভাগে ছিল জীবিকার আশ্বাসবাণী আইনপরীক্ষায় । একদিন সতীশ এসে বললেন, যদি আমাকে গ্ৰহণ করেন। আমি যোগ দিতে চাই আপনার কাজে । আমি বললুম, পরীক্ষা দিয়ে পরে চিন্তা কোরো। সতীশ বললেন, দেব না পরীক্ষা । কারণ পরীক্ষণ দিলেই আত্মীয়স্বজনের ধাক্কায় সংসারযাত্রার ঢালু। পথে আমাকে গড়িয়ে নিয়ে চলবে। কিছুতে তাকে নিরস্ত করতে পারলে না। দারিদ্র্যের ভার অবহেলায় মাথায় করে নিয়ে যোগ দিলেন আশ্রমের কাজে । বেতন অস্বীকার করলেন । আমি তার অগোচরে তঁর পিতার কাছে যথাসাধ্য মাসিক বৃত্তি পাঠিয়ে দিতুম । তার পরনে ছিল না জামা, একটা চাদর ছিল গায়ে, তার পরিধেয়তা জীৰ্ণ । যে ভােবরাজ্যে তিনি সঞ্চরণ করতেন সেখানে তার জীবন পূর্ণ হত প্রতিক্ষণে প্রকৃতির রসভাণ্ডার থেকে । আত্মভোলা মানুষ, যখন তখন ঘুরে বেড়াতেন যেখানে সেখানে | প্ৰায় তার সঙ্গে থাকত ছেলেরা, চলতে চলতে তার সাহিত্যসম্ভোগের আস্বাদন পেত তারাও । সেই অল্প বয়সে ইংরেজি সাহিতে্যু সুগভীর অভিনিবেশ তার মতো আর কারও মধ্যে পাই নি। যে-সব ছাত্রকে পড়বার ভার ছিল তার ’পরে তারা ছিল নিতান্তই অর্বাচীন। ইংরেজি ভাষার সোপানশ্রেণীর সব নীচেকার পইঠা পার করে দেওয়াই ছিল তার কাজ, কিন্তু কেজো সীমার মধ্যে বদ্ধ সংকীর্ণ নৈপুণ্য ছিল না তার মাস্টারিতে । সাহিত্যের তিনি রসজ্ঞ সাধক ছিলেন, সেইজন্যে তিনি যা পাঠ দিতেন তা জমা করবার নয়, তা হজম করবার, তা হয়ে উঠত ছেলেদের মনের খাদ্য । তিনি দিতেন তাদের মনকে অবগাহন-স্নান, তার গভীরতা অত্যাবশ্যকের চেয়ে অনেক বেশি । ভাষাশিক্ষার মধ্যে একটা অনিবাৰ্য শাসন থাকে, সেই শাসনকে অতিক্রম করে দিতে পারতেন সাহিত্যের উদার মুক্তি। এক বৎসরের মধ্যে হল তার মৃত্যু। তার বেদনা আজও রয়ে গেছে আমার মনে । আশ্রমে যারা শিক্ষক হবে তারা মুখ্যত হবে সাধক, আমার এই কল্পনাটি সম্পূর্ণ সত্য করেছিলেন সতীশ । তার পরের পর্বে এসেছিলেন জগদানন্দ । তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল সাধনা পত্রে তার প্রেরিত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ পড়ে। এই সকল প্রবন্ধের প্রাঞ্জল ভাষা ও সহজ বক্তব্যপ্রণালী দেখে তার প্রতি আমার বিশেষ শ্রদ্ধা আকৃষ্ট হয়েছিল। তার সাংসারিক অভাবমোচনের জন্য আমি তাকে প্রথমে আমাদের জমিদারির কাজে নিযুক্ত করেছিলেম। তার প্রধান কারণ জমিদারি দপ্তরে বেতনের কৃপণতা ছিল না । কিন্তু তাকে এই অযোগ্য আসনে বন্দী করে রাখতে আমার মনে বেদনা দিতে লািগল । আমি