পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আশ্রমের রূপ ও বিকাশ RR) তাকে শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনার কাজে আমন্ত্রণ করলুম। যদিও এই কার্যে আয়ের পরিমাণ অল্প ছিল তবুও আনন্দের পরিমাণ র্তার পক্ষে ছিল প্রচুর। তার কারণ শিক্ষাদানে তার স্বভাবের ছিল অকৃত্রিম তৃপ্তি। ছাত্রদের কাছে সর্বতোভাবে আত্মদানে তার একটুও কৃপণতা ছিল না । সুগভীর করুণা ছিল বালকদের প্রতি । শাস্তি উপলক্ষেও তাদের প্রতি লেশমাত্র নির্মমতা তিনি সহ্য করতে পারতেন না । একজন ছাত্রকে কোনো শিক্ষক তার একবেলার আহার বন্ধ করে দণ্ডবিধান করেছিলেন । এই শাসনবিধির নিষ্ঠুরতায় তাকে অশ্রু বর্ষণ করতে দেখেছি। তার বিজ্ঞানের ভাণ্ডার খোলা ছিল ছাত্রদের সম্মুখে যদিও তা তাদের পাঠ্য বিষয়ের অন্তর্গত ছিল না। এই আত্মদানের অকার্পণ্য যথার্থ শিক্ষকের যথার্থ পরিচয় । তিনি আপনার আসনকে কখনো ছাত্রদের কাছ থেকে দূরে রাখেন নি। আত্মমর্যাদার স্বাতন্ত্র্য রক্ষার চেষ্টায় তিনি ছাত্রদের সেবায় কখনো লাইন টেনে চলতেন না । তার অধ্যাপকের উচ্চ অধিকার তার সদয় ব্যবহারের আবরণে কখনো অতিপ্ৰত্যক্ষ ছিল না । বস্তুত সকল বিষয়েই তিনি ছেলেদের সখা ছিলেন । তার ক্লাসে গণিতশিক্ষায় কোনো ছাত্র কিছুমাত্র পিছিয়ে পড়ে পরীক্ষায় যদি অকৃতাৰ্থ হত সে তাকে অত্যন্ত আঘাত করত । শিক্ষার উচ্চ আদর্শ রক্ষার জন্য র্তার অক্লান্ত চেষ্টা ছিল । অমনোযোগী বালকদের প্রতি তার তর্জন গর্জন শুনতে অতিশয় ভয়জনক ছিল। কিন্তু তার স্নেহ র্তার ভৎসনাকে ভিতরে ভিতরে প্রতিবাদ করে চলত, ছাত্ররা তা প্রত্যহ অনুভব করেছে। যে শিক্ষকেরা আশ্রমের সৃষ্টিকাৰ্যে আপনাকে সর্বতোভাবে উৎসর্গ করেছিলেন, জগদানন্দ তার মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন । তার অভাব ও বেদনা আশ্রম কদাচ ভুলতে পারবে না। সতীশের বন্ধু অজিতকুমার যথার্থ শিক্ষকের পদে উচ্চ স্থান অধিকার করেছিলেন । তার বিদ্যা ছিল ইংরেজি সাহিত্যে ও দর্শনে বহুব্যাপ্ত | এই জ্ঞানের রাজ্যে তিনি ছিলেন ব্ৰজেন্দ্রনাথ শীলের ছাত্ৰ | তিনিও নির্বিচারে ছাত্রদের কাছে তার জ্ঞানের সঞ্চয় উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন । তার ছাত্রেরা সর্বদাই ঠার শিক্ষকতা থেকে উচ্চ অঙ্গের সাহিত্যরস আস্বাদনের অবকাশ পেয়েছিল। যদিও তাদের বয়স অল্প ও যোগ্যতার সীমা সংকীর্ণ তবুও তিনি কখনো তাদের কাছ থেকে নিজের পদের অভিমানে নির্লিপ্ত ছিলেন না। সতীশের মতো দারিদ্র্যে র্তার ঔদাসীন্য ছিল না। তবুও তিনি তা স্বীকার করে নিয়েছিলেন । আমাদের আশ্রম-নির্মাণ-কার্যে ইনি একজন নিপুণ স্থপতি ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। মাঝখানে অতি অল্প সময়ের জন্য এসেছিলেন আমার এক আত্মোৎসর্গপরায়ণ বন্ধু মোহিতচন্দ্ৰ সেন । তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন । সেখানকার খ্যাতি প্ৰতিপত্তি সমস্ত ত্যাগ করে যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষার এমন নিম্ন স্তরে লোকখ্যাতির দিক থেকে যা তার যোগ্য ছিল না। কিন্তু তাতেই তিনি প্রভূত আনন্দ পেয়েছিলেন। কারণ শিক্ষকতা ছিল তার স্বভাবসংগত । অল্পদিনের মধ্যেই তঁর মৃত্যু হয়ে শিক্ষাব্ৰত অকালে সমাপ্ত হয়ে গেল। তার অকৃপণতা ছিল আর্থিক দিকে এবং পারমার্থিক দিকে। প্রথম যেদিন আমার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল সেদিন তিনি আশ্রমের আদর্শের সম্বন্ধে যে সম্মান প্ৰকাশ করেছিলেন আমার আনন্দের পক্ষে তাই যথেষ্ট ছিল । অবশেষে বিদায় নেবার সময়ে তিনি বললেন, যদি আমি আপনার এখানকার কাজে যোগদান করতে পারতুম তবে নিজেকে কৃতাৰ্থ বোধ করাতুম। কিন্তু সম্প্রতি তা সম্ভব না হওয়াতে কিঞ্চিৎ শ্রদ্ধার অঞ্জলি দান করে গেলুম। এই বলে আমার হাতে একটি কাগজের মোড়ক দিয়ে গেলেন। পরে খুলে দেখলেম হাজার টাকার একখানি নোট । পরীক্ষকরূপে যা পেয়েছিলেন সমস্তই তিনি তার শ্রদ্ধার নিদর্শনরূপে দান করে গেলেন । কিন্তু কেবল সেই একদিনের দান নয়, তার পথ থেকে প্রতিদিন তিনি নিবেদন করেছেন তার শ্রদ্ধার অর্ঘ্য একান্ত অনুপযুক্ত বেতন রূপে । ঐদের অনেক পরে আশ্রমের সাধনাক্ষেত্রে দেখা দিলেন নন্দলাল। ছোটো বড়ো সমস্ত ছাত্রের সঙ্গে এই প্রতিভাসম্পন্ন আর্টিস্টের একাত্মকতা অতি আশ্চর্য। তাঁর আত্মদান কেবলমাত্র শিক্ষকতায় নয়, সর্বপ্রকার বদান্যতায় । ছাত্রদের রোগে, শোকে, অভাবে তিনি তাদের অকৃত্রিম বন্ধু। তাকে যারা শিল্পশিক্ষা উপলক্ষে কাছে পেয়েছে তারা ধন্য হয়েছে। তার পর থেকে নানা কমীি, নানা বন্ধু আশ্রমের সাধনাক্ষেত্রে সমবেত হয়েছেন এবং আপনি আপন S8 Sv.