পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিশ্বভারতী S8 পড়তাম। সেটা ছিল মল্লিকদের বাড়ি। সেখানে গাছপালা নেই, মার্বেলের উঠান আর ইটের উচু দেওয়াল যেন আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে থাকত। আমরা, যাদের শিশুপ্রকৃতির মধ্যে প্রাণের উদ্যম সতেজ ছিল, এতে বড়োই দুঃখ পেতাম। প্রকৃতির সাহচর্য থেকে দূরে থেকে আর মাস্টারদের সঙ্গে প্ৰাণগত যোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে আমাদের আত্মা যেন শুকিয়ে যেত। মাস্টাররা সব আমাদের মনে বিভীষিকার সৃষ্টি করত। প্ৰাণের সম্বন্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই-যে বিদ্যা লাভ করা যায়। এটা কখনো জীবনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠতে পারে না । আমি এ বিষয়ে কখনো কখনো বক্তৃতাও দিয়েছিলেম । কিন্তু যখন দেখলাম যে আমার কথাগুলি শ্রুতিমধুর কবিত্ব হিসাবেই সকলে নিলেন এবং যারা কথাটাকে মানলেন তঁরা এটাকে কাজে খাটাবার কোনো উদ্যোগ করলেন না, তখন আমার ভাবকে কর্মের মধ্যে আকার দান করবার জন্য আমি নিজেই কৃতসংকল্প হলাম। আমার আকাঙক্ষা হল, আমি ছেলেদের খুশি করব, প্রকৃতির গাছপালাই তাদের অন্যতম শিক্ষক হবে, জীবনের সহচর হবে- এমনি করে বিদ্যার একটি প্ৰাণনিকেতন নীড় তৈরি করে फूलब | তখন আমার ঘাড়ে মস্ত একটা দেন ছিল ; সে দেন। আমার সম্পূর্ণ স্বকৃত নয়, কিন্তু তার দায় আমারই একলার । দেনার পরিমাণ লক্ষ টাকারও অধিক ছিল । আমার এক পয়সার সম্পত্তি ছিল না, মাসিক বরাদ্দ অতি সামান্য । আমার বইয়ের কপিরাইট প্রভৃতি আমার সাধ্যায়ত্ত সামগ্ৰীর কিছু কিছু সওদা করে অসাধ্যসাধনে লেগে গেলাম। আমার ডাক দেশের কোথাও পৌঁছয় নি। কেবল ব্ৰহ্মবান্ধব উপাধ্যায়কে পাওয়া গিয়েছিল, তিনি তখনো রাজনীতিক্ষেত্রে নামেন নি । তার কাছে আমার এই সংকল্প খুব ভালো লাগল। তিনি এখানে এলেন । কিন্তু তিনি জমবার আগেই কাজ আরম্ভ করে দিয়েছিলাম। আমি পাঁচ-ছয়টি ছেলে নিয়ে জামগাছতলায় তাদের পড়াতাম । আমার নিজের বেশি বিদ্যে ছিল না । কিন্তু আমি যা পারি তা করেছি। সেই ছেলেকয়টিকে নিয়ে রস দিয়ে ভাব দিয়ে রামায়ণ মহাভারত পড়িয়েছি— তাদের কাদিয়েছি। হাসিয়েছি, ঘনিষ্ঠভাবে তাদের সঙ্গে যুক্ত থেকে তাদের মানুষ করেছি। এক সময় নিজের অনভিজ্ঞতার খেদে আমার হঠাৎ মনে হল যে, একজন হেডমাস্টারের নেহাত দরকার । কে যেন একজন লোকের নাম করে বললে, “অমুক লোকটি একজন ওস্তাদ শিক্ষক, যাকে তীর পাসের সোনার কাঠি ছুইয়েছেন সেই পাস হয়ে গেছে।”— তিনি তো এলেন, কিন্তু কয়েক দিন সব দেখেশুনে বললেন, ‘ ছেলেরা গাছে চড়ে, চেচিয়ে কথা কয়, দৌড়ীয়, এ তো ভালো না । আমি বললাম, 'দেখুন, আপনার বয়সে তো কখনো তারা গাছে চড়বে না। এখন একটু চড়তেই দিন-না ! গাছ যখন ডালপালা মেলেছে তখন সে মানুষকে ডাক দিচ্ছে। ওরা ওতে চড়ে পা বুলিয়ে থাকলেই-বা।” তিনি আমার মতিগতি দেখে বিরক্ত হলেন । মনে আছে, তিনি কিন্ডারগার্টেন-প্ৰণালীতে পড়বার চেষ্টা করতেন। তাল গোল, বেল গোল, মানুষের মাথা গোল ইত্যাদি সব পাঠ শেখাতেন। তিনি ছিলেন পাসের ধুরন্ধর পণ্ডিত, ম্যাট্রিকের কর্ণধার। কিন্তু এখানে তীর বনল না, তিনি বিদায় নিলেন । তার পর থেকে আর হেডমাস্টার রাখি নি । এ সামান্য ব্যাপার নয়, পৃথিবীতে অল্প বিদ্যালয়েই ছেলেরা এত বেশি ছাড়া পেয়েছে। আমি এ নিয়ে মাস্টারদের সঙ্গে লড়াই করেছি। আমি ছেলেদের বললাম, “তোমরা আশ্রম-সম্মিলনী করো, তোমাদের ভার তোমরা নাও । আমি কিছুতে আমার সংকল্প ত্যাগ করি নি- আমি ছেলেদের উপর জবরদস্তি হতে দিইনি। তারা গান গায়, গাছে চড়ে, ছবি আঁকে, পরস্পরের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ও বাধামুক্ত সম্বন্ধে যুক্ত হয়ে আছে। । এখানকার শিশুশিক্ষার আর-একটা দিক আছে। সেটা হচ্ছে- জীবনের গভীর ও মহৎ তাৎপর্য ছোটাে ছেলেদের বুঝতে দেওয়া। আমাদের দেশের সাধনার মন্ত্র হচ্ছে, যা মহৎ তাতেই সুখ, অল্পে সুখ নেই। কিন্তু এক রাজনীতিই এখন সেই বড়ো মহতের স্থান সমস্তটাই জুড়ে বসে আছে। আমার