পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

&Webr রবীন্দ্র-রচনাবলী আনন্দস্বরূপ, তোমার প্রকাশ পূর্ণ হােক। রুদ্র, তোমার রুদ্রতার মধ্যে অনেক দুঃখদারিদ্র্য আছেআমরা যেন বলতে পারি যে, সেই ঘন মেঘের আবরণ ভেদ করেও তোমার দক্ষিণ মুখ দেখেছি। ‘বেদাহম- জেনেছি। ‘আদিত্যবৰ্ণং তমসঃ পরস্তাৎ- অন্ধকারেরই ওপার থেকে দেখেছি জ্যোতির রূপ । তাই অন্ধকারকে আর ভয় করি নে। যে অন্ধকার নিজেদের ছোটাে গণ্ডির মধ্যেই আমাদের ছোটাে পরিচয়ে আবদ্ধ করে তাকে স্বীকার করি নে। যে আলো সকলের কাছে আমাদের প্রকাশ করে এবং সকলকে আমাদের কাছে প্ৰকাশ করে আমরা তারই অভিনন্দন করি । ৭ পৌষ ১৩৩০ Svobo শান্তিনিকেতন Ο Ο আজ আমার আর-একবার আশ্রম থেকে দূরে যাবার সময় উপস্থিত হয়েছে, হয়তো কিছু দীর্ঘকালের জন্যে এবার বিদেশে আমাকে কাটাতে হবে। যাবার পূর্বে আর-একবার এই আশ্রম সম্বন্ধে, এই কর্ম সম্বন্ধে আমাদের যা কথা আছে তা সুস্পষ্ট করে বলে যেতে চাই । আজ আমার চোখের সামনে আমাদের আশ্রমের এই বর্তমান ছবি- এই ছাত্রনিবাস কলাভবন গ্রন্থাগার অতিথিশালা, সব স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। ভাবছি, কী করে এর আরম্ভ, এর পরিণাম কোথায় । সকলের চেয়ে এইটেই আশ্চর্য যে, যে লোক একেবারে অযোগ্য- মনে করবেন না। এ কোনোরকম কৃত্রিম বিনয়ের কথা- তাকে দিয়ে এই কাজ সাধন করে নেবার বিধান । ছাত্রদের যেদিন এখানে আহবান করলুম। সেদিন আমার হাতে কেবল যে অর্থ ছিল না তা নয়, একটা বড়ো ঋণভাৱে তখন আমি একান্ত বিপন্ন । তা শোধ করবার কোনো উপায় আমার ছিল না । তার পরে বিদ্যাশিক্ষা দেওয়া সম্বন্ধে আমার যে কত অক্ষমতা ছিল তা সকলেই জানেন । আমি ভালো করে পড়ি নি, আমাদের দেশে যে শিক্ষাপ্রণালী প্রচলিত ছিল তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না । সব রকমের অযোগ্যতা এবং দৈন্য নিয়ে কাজে নেমেছিলুম। এর আরম্ভ অতি ক্ষীণ এবং দুর্বল ছিল, গুটি-পাঁচেক ছাত্র ছিল । ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন নিতুম না ; ছেলেদের অন্নবস্ত্ৰ, প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্ৰী যেমন করে হােক আমাকেই জোগাতে হত, অধ্যাপকদের সাংসারিক অভাব মোচন করতে হত । বৎসরের পর বৎসর যায়, অর্থাভাব সমানই রইল, বিদ্যালয় বাড়তে লাগল। দেখা গেল, বেতন না নিলে বিদ্যালয় রক্ষা করা যায় না। বেতনের প্রবর্তন হল ; কিন্তু অভাব দূর হল না। আমার গ্রন্থের স্বত্ব কিছু কিছু করে বিক্রয় করতে হল। এদিকে ওদিকে দু-একটা যা সম্পত্তি ছিল তা গেল, অলংকার বিক্রয় করলুম- নিজের সংসারকে রিক্ত করে কাজ চালাতে হল। কী দুঃসাহসে তখন প্ৰবৃত্ত হয়েছিলুম জানি নে । স্বপ্নের ঘোরে যে মানুষ দুৰ্গম পথে ঘুরে বেরিয়েছে সে যেমন জেগে উঠে কেঁপে ওঠে, আজি পিছন দিকে যখন তাকিয়ে দেখি তখন আমারও সেই রকমের হৃৎকম্প হয় । অথচ এটি সামান্যই একটি বিদ্যালয় ছিল । কিন্তু এই সামান্য ব্যাপারটি নিয়েই আবালা-কালের সাহিত্যসাধনাও আমাকে অনেক পরিমাণে বর্জন করতে হল । এর কারণ কী, এত আকর্ষণ কিসের | এই প্রশ্নের যে উত্তর আমার মনে আসছে সেটা আপনাদের কাছে বলি। অতি গভীরভাবে নিবিড়ভাবে এই বিশ্বপ্রকৃতিকে শিশুকাল থেকে আমি ভালোবেসেছি। আমি খুব প্রবলভাবেই অনুভব করেছি যে, শহরের জীবনযাত্রা আমাদের চার দিকে যন্ত্রের প্রাচীর তুলে দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে আমাদের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিয়েছে। এখানকার আশ্রমে, প্রকৃতির প্রাণীনিকেতনের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে, বসন্ত-শরতের পুষ্পোৎসবে ছেলেদের যে স্থান করে দিয়েছি তারই আনন্দে দুঃসাধ্য ত্যাগের মধ্যে আমাকে ধরে রেখেছিল। প্রকৃতি মাতা যে অমৃত পরিবেশন করেন সেই অমৃত গানের সঙ্গে মিলিয়ে নানা আনন্দ-অনুষ্ঠানের মধ্যে