পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

NaVy রবীন্দ্র-রচনাবলী বাংলাদেশকে বাংলা ভাষার ভিতর চিরজীবন আমি সেবা করেছি, আমার পয়ষট্টি বৎসর বয়সের মধ্যে অন্তত পঞ্চান্ন বৎসর আমি সাহিত্যের সাধনা করে সরস্বতীর কাছ থেকে যা-কিছু বর লাভ করেছি সমস্তই বুংিলাদেশের ভাণ্ডারে জমা করে দিয়েছি। এইজন্য বাংলাদেশের কাছ থেকে আমি যতটুকু স্নেহ ও সম্মান লাভ করেছি। তার উপরে আমার নিজের দাবি আছে- বাংলাদেশ যদি কৃপণতা করে, ঘদি আমাকে আমার প্রাপ্য না দেয়, তা হলে অভিমান করে আমি বলতে পারি যে, আমার কাছে বাংলাদেশ ঋণী রয়ে গেল । কিন্তু বাংলার বাইরে বা বিদেশে যে সমাদর, যে শ্ৰীতি লাভ করি তার উপরে আমার আত্মাভিমানের দাবি নেই। এইজন্য এই দানকেই ভগবানের দান বলে আমি গ্ৰহণ করি। তিনি আমাকে দয়া করেন, নতুবা অপরেরা আমাকে দয়া করেন এমন কোনো হেতু নেই। ভগবানের এই দানে মন নম্র হয়, এতে অহংকার জন্মে না । আমরা নিজের পকেটের চার-আনার পয়সা নিয়েও গর্ব করতে পারি, কিন্তু ভগবান আকাশ ভরে যে সোনার আলো ঢেলে দিয়েছেন, কোনো কালেই যার মূল্য শোধ করতে পারব না, সেই আলোর অধিকার নিয়ে কেবল আনন্দই করতে পারি, কিন্তু গর্ব করতে পারি নে। পরের দত্ত সমােদরও সেইরকম অমূল্য- সেই দান আমি নম্রশিরেই গ্ৰহণ করি, উদ্ধতিশিরে নয় । এই সমাদরে আমি বাংলাদেশের সন্তান বলে উপলব্ধি করবার সুযোগ লাভ করি নি । বাংলাদেশের ছোটো ঘরে আমার গর্ব করবার স্থান ছিল, কিন্তু ভারতের বড়ো ঘরে আমার আনন্দ করবার স্থান । আমার প্রভু আমাকে তার দেউড়িতে কেবলমাত্র বাঁশি বাজাবার ভার দেন নি— শুধু কবিতার মালা গাথিয়ে তিনি আমাকে ছুটি দিলেন না। আমার যৌবন যখন পার হয়ে গেল, আমার চুল যখন পাকল, তখন তার অঙ্গনে আমার তলব পড়ল । সেখানে তিনি শিশুদের মা হয়ে বসে আছেন । তিনি আমাকে হেসে বললেন, ‘ওরে পুত্র, এতদিন তুই তো কোনো কাজেই লাগলি নে, কেবল কথাই গেঁথে বেড়ালি। বয়স গেল, এখন যে কয়টা দিন বাকি আছে, এই শিশুদের সেবা কর।” কাজ শুরু করে দিলুম— সেই আমার শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের কাজ। কয়েকজন বাঙালির ছেলেকে নিয়ে মাস্টারি শুরু করে দিলুম। মনে অহংকার হল, এ আমার কাজ, এ আমার সৃষ্টি । মনে হল, আমি বাংলাদেশের হিতসাধন করছি, এ আমারই শক্তি । কিন্তু এ যে প্রভুরই আদেশ- যে প্ৰভু কেবল বাংলাদেশের নন- সেই কথা যার কাজ তিনিই স্মরণ করিয়ে দিলেন। সমুদ্রপার হতে এলেন বন্ধু অ্যাভূজ.এলেন বন্ধু পিয়ার্সন। আপনি লোকের বন্ধুত্বের উপর দাবি আছে, সে বন্ধুত্ব আপন লোকেরই সেবায় লাগে । কিন্তু ধাদের সঙ্গে নাড়ীর সম্বন্ধ নেই, যাদের ভাষা স্বতন্ত্র, ব্যবহার স্বতন্ত্র, তারা যখন অনাহুত আমার পাশে এসে দাড়ােলন তখনই আমার অহংকার ঘুচে গেল, আমার আনন্দ জন্মাল । যখন ভগবান পরকে আপন করে দেন, তখন সেই আত্মীয়তার মধ্যে ঠাকেই আত্মীয় বলে জানতে পারি । আমার মনে গর্ব জন্মেছিল যে, আমি স্বদেশের জন্য অনেক করছি- আমার অর্থ, আমার সামৰ্থ আমি স্বদেশকে উৎসর্গ করছি। আমার সেই গর্ব চূৰ্ণ হয়ে গেল যখন বিদেশী এলেন এই কাজে । তখনই বুঝলুম, এও আমার কাজ নয়, এ তারই কাজ, যিনি সকল মানুষের ভগবান । এই-যে বিদেশী বন্ধুদের অযাচিত পাঠিয়ে দিলেন, এঁরা আত্মীয়স্বজনদের হতে বহু দূরে পৃথিবীর প্রান্তে ভারতের প্রান্তে এক খ্যাতিহীন প্ৰান্তরের মাঝখানে নিজেদের সমস্ত জীবন ঢেলে দিলেন ; একদিনের জন্যও ভাবলেন না, যাদের জন্য র্তাদের আত্মোৎসর্গ তারা বিদেশী, তারা পূৰ্বদেশী, তারা শিশু, তাদের ঋণ শোধ করবার মতো অর্থ তাদের নেই, শক্তি তাদের নেই, মান তাদের নেই। তারা নিজে পরম পণ্ডিত, কত সম্মানের পদ তাদের জন্য পথ চেয়ে আছে, কত উর্ধব বেতন তাদের আহবান করছে, সমন্ত ঠার প্ৰত্যাখ্যান করেছেন- অকিঞ্চনভাবে, স্বদেশীর সম্মান ও স্নেহ হতে বঞ্চিত হয়ে, রাজপুরুষদের সন্দেহ -দ্বারা অনুধাবিত হয়ে গ্ৰীষ্ম এবং রোগের তাপে তাপিত হয়ে ঠারা কাজে প্ৰবৃত্ত হলেন । এ কাজের বেতন তারা নিলেন না, দুঃখই নিলেন। তঁরা আপনাকে বড়ো করলেন না, প্রভুর আদেশকে