পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ՀԵr3 রবীন্দ্র-রচনাবলী সে ছিল আমাদের যথার্থ তপস্যা। অর্থের এত অভাব ছিল যে, আজ জগদব্যাপী দুঃসময়েও তা কল্পনা করা যায় না। আর সে কথা কোনোকালে কেউ জানবেও না, কোনো ইতিহাসে তা লিখিত হবে না। আশ্রমের কোনো সম্পত্তি ছিল না, সহায়তা ছিল না- চাইও নি। এইজন্যই, যারা তখন এখানে কাজ করেছেন তঁরা অন্তরে দান করেছেন, বাইরে কিছু নেন নি। যে আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে এখানে এসেছি। তার বোধ সকলেরই মনে যে স্পষ্ট বা প্রবল ছিল তা নয়, কিন্তু অল্প পরিসরের মধ্যে তা নিবিড় হতে পেরেছিল। ছাত্রেরা তখন আমাদের অত্যন্ত নিকটে ছিল, অধ্যাপকেরাও পরস্পর অত্যন্ত নিকটে ছিলেন- পরম্পরের সুহৃৎ ছিলেন তারা। আমাদের দেশের তপোবনের আদর্শ আমি নিয়েছিলাম। কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সে আদর্শের রূপের পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু তার মূল সত্যটি ঠিক আছেসেটি হচ্ছে, জীবিকার আদর্শকে স্বীকার করে তাকে সাধনার আদর্শের অনুগত করা। এক সময়ে এটা অনেকটা সুসাধ্য হয়েছিল, ফখন জীবনযাত্রার পরিধি ছিল অনতিবৃহৎ । তাই বলেই সেই স্বল্পায়তনের মধ্যে সহজ জীবনযাত্ৰাই শ্রেষ্ঠ আদর্শ, এ কথা সম্পূর্ণ সত্য নয়। উচ্চতর সংগীতে নানা ক্রটি ঘটতে পারে ; একতারায় ভুলচুকের সম্ভাবনা কম, তাই বলে একতারাই শ্ৰেষ্ঠ এমন নয়। বরঞ্চ কর্ম যখন বহুবিস্তৃত হয়ে বন্ধুর পথে চলতে থাকে তখন তার সকল ভ্ৰমপ্ৰমাদ সত্বেও যদি তার মধ্যে প্ৰাণ থাকে তবে তাকেই শ্রদ্ধা করতে হবে। শিশু অবস্থার সহজতাকে চিরকাল বেঁধে রাখবার ইচ্ছা ও চেষ্টার মতো বিড়ম্বনা আর কী আছে। আমাদের কর্মের মধ্যেও সেই কথা । যখন একলা ছোটো কাৰ্যক্ষেত্রের মধ্যে ছিলুম তখন সব কর্মীদের মনে এক অভিপ্ৰায়ের প্রেরণা সহজেই কাজ করত। ক্রমে ক্রমে যখন এ আশ্রম বড়ো হয়ে উঠল তখন একজনের অভিপ্ৰায় এর মধ্যে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ পাবে এ সম্ভব হতে পারে না । অনেকে এখানে এসেছেন, বিচিত্র তাদের শিক্ষাদীক্ষা- সকলকে নিয়েই আমি কাজ করি, কাউকে বাছাই করি নে, বাদ দিই নে ; নানা ভুলত্রুটি ঘটে, নানা বিদ্ৰোহ-বিরোধ ঘটে- এ-সব নিয়েই জটিল সংসারে জীবনের যে প্রকাশ ঘাতভিঘাতে সর্বদা আন্দোলিত তাকে আমি সম্মান করি । আমার প্রেরিত আদর্শ নিয়ে সকলে মিলে একতারা-যত্নে গুঞ্জরিত করবেন। এমন অতি সরল ব্যবস্থাকে আমি নিজেই শ্রদ্ধা করি নে। আমি যাকে বড়ো বলে জানি, শ্রেষ্ঠ বলে যা বরণ করেছি, অনেকের মধ্যে তার প্রতি নিষ্ঠার অভাব আছে জানি, কিন্তু তা নিয়ে নালিশ করতে চাই নে । আজ, আমি বর্তমান থাকা সত্ত্বেও এখানকার যা কর্ম তা নানা বিরোধ ও অসংগতির মধ্য দিয়ে প্ৰাণের নিয়মে আপনি তৈরি হয়ে উঠছে ; আমি যখন থাকব না, তখনো অনেক চিত্তের সমবেত উদ্যোগে যা উদভাবিত হতে থাকবে তাই হবে সহজ সত্য । কৃত্রিম হবে। যদি কোনো এক ব্যক্তি নিজের আদেশ-নির্দেশে একে বাধ্য করে চালায়-প্ৰাণধর্মের মধ্যে স্বতোবিরোধিতাকেও স্বীকার করে নিতে হয় । অনেক দিন পরে আজ এ আশ্রমকে সমগ্র করে দেখতে পাচ্ছি ; দেখছি, আপনি নিয়মে এ আপনি গড়ে উঠেছে। গঙ্গা যখন গঙ্গোত্রীর মুখে তখন একটিমাত্র তার ধারা। তার পর ক্রমে বহু নদনদীর সহিত যতই সে সংগত হল, সমুদ্রের যত নিকটবতী হল, কত তার রূপান্তর ঘটেছে। সেই আদিম স্বচ্ছতা আর তার নেই, কত আবিলতা প্রবেশ করেছে তার মধ্যে, তবু কেউ বলে না গঙ্গার উচিত ফিরে যাওয়া, যেহেতু অনেক মলিনতা ঢুকেছে তার মধ্যে, সে সরল গতি আর তার নেই। সব নিয়ে যে সমগ্ৰতা সেইটিই বড়ো- আশ্রমও স্বতোধাবিত হয়ে সেই পথেই চলেছে, অনেক মানুষের চিত্তসম্মিলনে আপনি গড়ে উঠেছে। অবশ্য এর মধ্যে একটা ঐক্য এনে দেয় মূলগত একটি আদিম বেগ ; তারও প্রয়োজন আছে, অথচ এর গতি প্রবল হয় সকলের সম্মিলনে। নিত্যকালের মতো কিছুই কল্পনা করা চলে না- তবে এর মূলগত একটি গভীর তত্ত্ব বরাবর থাকবে এ কথা আমি আশা করি।-- সে কথা এই যে, এটা বিদ্যশিক্ষার একটা খচা হবে না, এখানে সকলে মিলে একটি প্রাণলোক সৃষ্টি করবে। এমনতরো স্বৰ্গলোক কেউ রচনা করতে পারে না। যার মধ্যে কোনো কলুষ নেই, দুঃখজনক কিছু নেই ; কিন্তু বন্ধুরা জানবেন যে, এর মধ্যে যা নিন্দনীয় সেইটাই বড়ো নয়। চোখের পাতা ওঠে, চোখের পাতা পড়ে ; কিন্তু পড়াটাই বড়ো নয়, সেটাকে বড়ো বললে অন্ধতাকে বড়ো বলতে হয়। ধারা প্রতিকুল, নিন্দার বিষয় তারা পাবেন না এমন নয়-নিন্দনীয়তার হাত থেকে কেউই রক্ষা পেতে