পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sberber রবীন্দ্র-রচনাবলী থাকে। তবেই দেশের অন্তরাত্মা জেগে উঠতে পারে। মানুষের প্রকৃতিতে উর্ধর্বদেশে আছে তার নিষ্কাম কর্মের আদেশ, সেইখানে প্রতিষ্ঠিত আছে সেই বেদী যেখানে অন্য কোনো আশা না রেখে সে সত্যের কাছে বিশুদ্ধভাবে আত্মসমৰ্পণ করতে পারে- আর কোনো কারণে নয়, তাতে তার আত্মারই পূর্ণতা হয় বলে । আমাদের দেশে এখানে সেখানে দূরে দূরে গুটিকয়েক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সেখানে বীধা নিয়মে যান্ত্রিক প্ৰণালীতে ডিগ্রি বানাবার কারখানাঘর বসেছে। এই শিক্ষার সুযোগ নিয়ে ডাক্তার এজিনিয়র উকিল প্রভৃতি ব্যবসায়ীদের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। কিন্তু সমাজে সত্যের জন্য কর্মের জন্য নিষ্কাম আত্মনিয়োগের ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা হয় নি। প্রাচীন কালে ছিল তপোবন ; সেখানে সত্যের অনুশীলন এবং আত্মার পূর্ণতা-বিকাশের জন্য সাধকেরা একত্র হয়েছেন, রাজস্বের ষষ্ঠ অংশ দিয়ে এই সকল আশ্রমকে রক্ষা করা রাজাদের কর্তব্য ছিল। সকল সভ্য দেশেই জ্ঞানের তাপস কর্মের ব্ৰতীদের জন্যে তপোতৃভূমি রচিত হয়েছে। আমাদের দেশে সাধনা বলতে সাধারণত মানুষ আধ্যাত্মিক মুক্তির সাধনা, সন্ন্যাসের সাধনা ধরে নিয়ে থাকে । আমি যে সংকল্প নিয়ে শান্তিনিকেতনে আশ্রম-স্থাপনার উদ্যোগ করেছিলুম, সাধারণ মানুষের চিত্তোৎকর্ষের সুদূর বাইরে তার লক্ষ্য ছিল না। যাকে সংস্কৃতি বলে তা বিচিত্র ; তাতে মনের সংস্কার সাধন করে, আদিম খনিজ অবস্থার অনুজ্বলতা থেকে তার পূর্ণ মূল্য উদভাবন করে নেয়। এই সংস্কৃতির নানা শাখাপ্রশাখা ; মন যেখানে সুন্থ সবল, মন সেখানে সংস্কৃতির এই নানাবিধ প্রেরণাকে আপনিই চায় । ব্যাপকভাবে এই সংস্কৃতি-অনুশীলনের ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করে দেব, শান্তিনিকেতন-আশ্রমে এই আমার অভিপ্ৰায় ছিল । আমাদের দেশের বিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তকের পরিধির মধ্যে জ্ঞানচর্চার যে সংকীর্ণ সীমা নির্দিষ্ট আছে কেবলমাত্র তাই নয়, সকলেরকম কারুকার্য শিল্পকলা নৃত্যগীতবাদ্য নাট্যাভিনয় এবং পঞ্জীহিতসাধনের জন্যে যে-সকল শিক্ষা ও চর্চার প্রয়োজন সমন্তই এই সংস্কৃতির অন্তৰ্গতবালেখীকার করব। চিত্তের পূর্ণবিকাশের পক্ষে এই সমস্তেরই প্রয়োজন আছে বলে আমি জানি। খাদ্যে নানা প্রকারের প্রাণীন পদার্থ আমাদের, শরীরে মিলিত হয়ে আমাদের দেয় স্বাস্থ্য, দেয় বল ; তেমনি যে-সকল শিক্ষণীয় বিষয়ে মনের প্রাণীন পদাৰ্থ আছে তার সবগুলিরই সমবায় হবে। আমাদের আশ্রমের সাধনায়- এই কথাই আমি অনেক কাল চিন্তা করেছি । পদ্মার বোটে ছিল আমার নিভৃত নিবাস। সেখান থেকে আশ্ৰমে চলে এসে আমার আসন নিলুম গুটি পাঁচ-ছয় ছেলের মাঝখানে । কেউ না মনে করেন, তাদের উপকার করাই ছিল আমার লক্ষ্য । ক্লাস-পড়ানো কাজে উপকার করার সম্বল আমার ছিল না। বস্তুত সাধনা করার আগ্রহ আমাকে পেয়ে বসেছিল, আমার নিজেরই জন্যে। নিজেকে দিয়ে-ফেলার দ্বারা নিজেকে পাওয়ার লোভ আমাকে দখল করেছিল । ছোটাে ছেলেদের পড়বার কাজে দিনের পরে দিন আমার কেটেছে, তার মধ্যে খ্যাতির প্রত্যাশা বা খ্যাতির স্বাদ পাবার উপায় ছিল না। সব চেয়ে নিম্নশ্রেণীর ইস্কুলমাস্টারি। ঐ কািট ছোটাে ছেলে আমার সমন্ত সময় নিলে, অর্থ নিলে, সামর্থ্য নিলে- এইটেই আমার সার্থকতা। এই যে আমার সাধনার সুযোগ ঘটল, এতে করে আমি আপনাকেই পেতে লাগলুম। এই আত্মবিকাশ, এ কেবল সাধনার ফলে, বৃহৎ মানবজীবনের সংগমক্ষেত্রে। আপনাকে সরিয়ে ফেলতে পারলেই বৃহৎ মানুষের সংসর্গ পাওয়া যায়, এই সামান্য ছেলে-পড়ানের মধ্যেও । এতে খ্যাতি নেই, স্বাৰ্থ নেই, সেইজনেই এতে বৃহৎ মানুষের স্পর্শ আছে। সকলে জানেন, আমি মানুষের কোনো চিত্তবৃত্তিকে অস্বীকার করি নি। বাল্যকাল থেকে আমার কাব্যসাধনার মধ্যে যে আত্মপ্রকাশের প্রবল ইচ্ছা জাগ্রত ছিল মানুষের সকল চিত্তবৃত্তির পরেই তার অভিমুখতা। ফলে কােনে উৎশক্তিৰ ভ্ৰষ্টলৱেই আমি পলতাৰা গীর্জন দাগ ছি বহু বৎসর আমি নদীতীরে নৌকাবাসে সাহিত্যসাধনা করেছি, তাতে আমার নিয়তিশয় শাতি ও