পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

RSO রবীন্দ্র-রচনাবলী dò অনেক দিন পরে আজ আমি তোমাদের সম্মুখে এই মন্দিরে উপস্থিত হয়েছি। অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গেই আজ এসেছি। এ কথা জানি যে, দীর্ঘকালের অনুপস্থিতির ব্যবধানে আমার বহুকালের অনেক সংকল্পের গ্ৰন্থি শিথিল হয়ে এসেছে। যে কারণেই হােক, তোমাদের মন এখন আর প্রস্তুত নেই আশ্রমের সকল অনুষ্ঠানের সকল কর্তব্যকর্মের অন্তরের উদ্দেশ্যটি গ্রহণ করতে, এ কথা অস্বীকার করে লাভ নেই। এর জন্যে শুধু তোমরা নও, আমরা সকলেই দায়ী । আজ মনে পড়ছে চল্লিশ বৎসর পূর্বের একটি দিনের কথা। বাংলার নিভৃত এক প্রান্তে আমি তখন ছিলাম পদ্মানদীর নির্জন তীরে। মন যখন সে দিকে তাকায়, দেখতে পায় যেন এক দূর যুগের প্ৰত্যুষের আভা । কখন এক উদবোধনের মন্ত্ৰ হঠাৎ এল আমার প্রাণে । তখন কেবলমাত্র কবিতা লিখে দিন কাটিয়েছি ; অধ্যয়ন ও সাহিত্যালোচনার মধ্যে ডুবেছিলাম, তারই সঙ্গে ছিল বিষয়াকর্মের বিপুল বোঝা । কেন সেই শান্তিময় পল্লীশ্ৰীীর নিবন্ধ আবেষ্টন থেকে টেনে নিয়ে এল আমাকে এই রৌদ্রদগ্ধ মরুপ্রান্তরে তা বলতে পারি না । এখানে তখন বাইরে ছিল সব দিকেই বিরলতা ও বিজনতা, কিন্তু সব সময়েই মনের মধ্যে ছিল একটি পরিপূর্ণতার আশ্বাস। একাগ্ৰচিত্তে সর্বদা আকাঙ্ক্ষা করেছি, বর্তমান কালের তুচ্ছতা ইত্যরতা প্ৰগলভ্যতা সমস্ত দূর করতে হবে। যাদের শিক্ষাদানের ভার গ্রহণ করেছি, ভারতের যুগান্তরব্যাপী সাধনার অমৃত উৎসে তাদের পৌঁছে দিতে পারব, এই আশাই ছিল অন্তরের গভীরে । কতদিন এই মন্দিরের সামনের চাতালে দুটি একটি মাত্র উপাসক নিয়ে সমবেত হয়েছি- অবিরত চেষ্টা ছিল সুপ্ত প্রাণকে জাগাবার। তারই সঙ্গে আরো চেষ্টা ছিল ছেলেদের মনে তাদের স্বাধীন কর্মশক্তি ও মননশক্তিকে উদবুদ্ধ করতে । কোনোদিনই খণ্ডভাবে আমি শিক্ষা দিতে চাইনি। ক্লাসের বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থায় তাদের শিক্ষার সমগ্রতাকে আমি কখনো বিপর্যন্ত করি নি । সেদিনের সে আয়োজন অন্ধ-অনুষ্ঠানের দ্বারা স্নান ছিল না, অপমানিত ছিল না অভ্যাসের ক্লান্তিতে । এমন কোনো কাজ ছিল না। যার সঙ্গে নিবিড় যোগ ছিল না আশ্রমের কেন্দ্ৰস্থলবতী শ্ৰদ্ধার একটি মূল উৎসের সঙ্গে । স্নানপান-আহারে সেদিনের সমগ্র জীবনকে অভিষিক্ত করেছিল এই উৎস। শান্তিনিকেতনের আকাশবাতাস পূর্ণ ছিল এরই চেতনায় । সেদিন কেউ একে অবজ্ঞা করে অন্যমনস্ক হতে পারত না । আজ বার্ধক্যের ভাটার টানে তোমাদের জীবন থেকে দূরে পড়ে গেছি। প্রথম যে আদর্শ বহন করে এখানে এসেছিলুম, আমার জীৰ্ণ শক্তির অপটুতা থেকে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে নিজের হাতে বহন করবার। আনন্দিত উদ্যম কোথাও দেখতে পাচ্ছি নে । মনে হয়, এ যেন বর্তমান কালেরই বৈশিষ্ট্য। সাব-কিছুকে সন্দেহ করা, অপমান করা, এতেই যেন তার স্পর্ধা । তারই তো বীভৎস লক্ষণ মারাবিস্তার করে ফুটে উঠেছে দেশে বিদেশে আজকের দিনের রাষ্ট্রে সমাজে, বিদ্যুপ করছে তাকে যা মানব-সভ্যতার চিরদিনের সাধনার সামগ্ৰী । চল্লিশ বৎসর পূর্বে যখন এখানে প্রথম আসি তখন আশ্রমের আকাশ ছিল নির্মল। কেবল তাই নয়, তখন বিষবাষ্প ব্যাপ্ত হয় নি মানবসমাজের দিগদিগন্তে । আজ আবার আসছি। তোমাদের সামনে যেন বহুদূরের থেকে । আর-একবার মনে পড়ছে এই আশ্রমে প্রথম প্রবেশ করবার দীর্ঘ বন্ধুর পথ। বিরুদ্ধ ভাগ্যের নির্মমতা ভেদ করে সেই- যে পথযাত্রা চলেছিল সম্মুখের দিকে তার দুঃসহ দুঃখের ইতিহাস কেউ জানবে না। আজ এসেছি সেই দুঃখস্মৃতির ভিতর দিয়ে। উৎকণ্ঠিত মনে তোমাদের মধ্যে খুঁজতে এলাম তার সার্থকতা। আধুনিক যুগের শ্রদ্ধাহীন স্পর্ধা-দ্বারা এই তপস্যাকে মন থেকে প্রত্যাখ্যান কোরো না- একে স্বীকার করে নাও। ইতিহাসে বিপর্যয় বহু ঘটেছে, সভ্যতার বহু কীর্তিমন্দির যুগে যুগে বিধ্বন্ত হয়েছে, তবু মানুষের