পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমবায়নীতি \ORGł কারণে নগর প্রধানত প্ৰতিযোগিতার ক্ষেত্র, এখানে সহযোগিতাবৃত্তি যথোচিত উৎসাহ পায় না । শক্তি-উদভাবনার জন্যে অহমিকা ও প্রতিযোগিতার প্রয়োজন আছে। কিন্তু যখনই তা পরিমাণ লঙঘন করে তখনই তার ক্রিয়া সাংঘাতিক হয়। আধুনিক সভ্যতায় সেই পরিমিতি অনেক দূর ছড়িয়ে গেছে । কেননা, এ সভ্যতা বিরল্যাঙ্গিক নয়, বহুলাঙ্গিক । এর প্রকাশ ও রক্ষার জন্যে বহু আয়োজনের দরকার ; একে ব্যয় করতে হয় বিস্তর । এই সভ্যতায় সম্বলের স্বল্পতা একটা অপরাধেরই মতো, কেননা বিপুল উপকরণের ভিত্তির উপরেই এ দাড়িয়ে আছে ; যেখানেই অর্থদৈন্য সেখানেই এর বিরুদ্ধতা । বিদ্যাই হােক, স্বাস্থ্যই হােক, আমোদ-আহলাদ হোক, রাস্তাঘাট আইন-আদালত যানবাহন অশন-আসন যুদ্ধচালনা শান্তিরক্ষা সমস্তই বহুধনসাধ্য। এই সভ্যতা দরিদ্রকে প্রতিক্ষণেই অপমানিত করে। কেননা, দারিদ্র্য একে বাধাগ্রস্ত করতে থাকে। এই কারণে ধন বর্তমানকালে সকল প্রভাবের নিদান এবং সকলের চেয়ে সমাদৃত । বস্তুত আজকালকার দিনের রাষ্ট্রনীতির মূলে রাজপ্রতাপের লোভ নেই, ধন-অর্জনের জন্য বাণিজ্যবিস্তারের লোভ । সভ্যতা যখন এখনকার মতো এমন বহুলাঙ্গিক ছিল না। তখন পণ্ডিতের গুণীর বীরের দাতার কীৰ্তিমানের সমাদর ধনীর চেয়ে অনেক বেশি ছিল , সেই সমাদরের দ্বারা যথার্থ ভাবে মনুষ্যত্বের সম্মান করা হত । তখন ধন সঞ্চায়ীদের 'পরে সাধারণের অবজ্ঞা ছিল । এখনকার সমস্ত সভ্যতাই ধনের পরাশিত (parasite)। তাই শুধু ধনের অর্জন নয়, ধনের পূজা প্রবল হয়ে উঠেছে। অপদেবতার পূজায় মানুষের শুভবুদ্ধিকে নষ্ট করে, আজ পৃথিবী জুড়ে তার প্রমাণ দেখা যাচ্ছে। মানুষ মানুষের এত বড়ো প্রবল শত্রু আর কোনো দিন ছিল না, কারণ ধনলোভের মতো এমন নিষ্ঠুর এবং অন্যায়পরায়ণ প্রবৃত্তি আর নেই। আধুনিক সভ্যতার অসংখ্যবাহুচালনায় এই লোভই সর্বত্র উন্মথিত এবং এই লোভপরিতৃপ্তির আয়োজন তার অন্য-সকল উদ্যোগের চেয়ে পরিমাণে বেড়ে চলেছে। কিন্তু এ কথা নিশ্চয়ই জানতে হবে যে, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু | কারণ, লোভ সামাজিকতার প্রতিকূল প্রবৃত্তি। যাতেই মানুষের সামাজিকতাকে দুর্বল করে তাতেই পদে পদে আত্মবিচ্ছেদ ঘটায়, অশান্তির আগুন কিছুতেই নিবতে দেয় না, শেষকালে মানুষের সমাজস্থিতি বিভক্ত হয়ে পঞ্চােত্ব পায় । পাশ্চাত্য দেশে আজ দেখতে পাচ্ছি, যারা ধন-অৰ্জন করেছে এবং যারা অর্জনের বাহন তাদের মধ্যে কোনোমতেই বিরোধ মিটছে না। মেটাবার উপায়ও নেই। কেননা, যে মানুষ টাকা করছে তারও লোভ যতখানি যে মানুষ টাকা জোগাচ্ছে তারও লোভ তার চেয়ে কম নয় । সভ্যতার সুযোগ যথেষ্টপরিমাণে ভোগ করবার জন্যে প্রচুর ধানের আবশ্যকতা উভয়পক্ষেই। এমন স্থলে পরস্পরের মধ্যে ঠেলাঠেলি কোনো এক জায়গায় এসে থামবে, এমন আশা করা যায় না। লোভের উত্তেজনা, শক্তির উপাসনা, যে অবস্থায় সমাজে কোনো কারণে অসংযত হয়ে দেখা দেয় সে অবস্থায় মানুষ আপনি সর্বাঙ্গীণ মনুষ্যত্ব-সাধনার দিকে মন দিতে পারে না ; সে প্রবল হতে চায়, পরিপূর্ণ হতে চায় না। এইরকম অবস্থাতেই নগরের আধিপত্য হয় অপরিমিত, আর গ্রামগুলি উপেক্ষিত হতে থাকে। তখন যতী-কিছু সুবিধা সুযোগ, যতী-কিছু ভোগের আয়োজন, সমস্ত নগরেই পূজিত হয়। গ্রামগুলি দাসের মতো অন্ন জোগায়, এবং তার পরিবর্তে কোনোমতে জীবনধারণ করে মাত্র । তাতে সমাজের মধ্যে এমন-একটা ভাগ হয় যাতে এক দিকে পড়ে তীব্ৰ আলো, আর-এক দিকে গভীর অন্ধকার। যুরোপের নাগরিক সভ্যতা মানুষের সর্বাঙ্গণতাকে এই রকমে বিচ্ছিন্ন করে। প্রাচীন স্ত্রীসের সমন্ত সভ্যতা তার নগরে সংহত ছিল ; তাতে ক্ষণকালের জন্য ঐশ্বর্যসৃষ্টি করে সে লুপ্ত হয়েছে। প্ৰভু এবং দাসের মধ্যে তার ছিল একান্ত ভাগ। প্ৰাচীন ইটালি ছিল নাগরিক । কিছুকাল সে প্রবল ভাবে শক্তির সাধনা করেছিল। কিন্তু শক্তির প্রকৃতি সহজেই অসামাজিক- সে শক্তিমান ও শক্তির বাহনকে একান্ত বিভূক্ত করে দেয়, তাতে করে অল্পসংখ্যক প্ৰভু বহুসংখ্যক দাসের পরাশিত ইয়ে পড়ে, এই পারাশিত মানুষ্যত্বের ভিত্তি মই করে। পাশ্চাত্য মহাদেশের সভ্যতা নাগরিক ; সেখানকার লোকে কেবল নিজের দেশে নয়, জগৎ জুড়ে মানবলোককে আলো-অন্ধকারে ভাগ করছে। তাদের এত বেশি আকাঙক্ষা যে, সে আকাঙক্ষার নিবৃত্তি S8 ISS