পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩২৬ ब्रदीक्ष-ब्रानावर्दी সহজে তাদের নিজের অধিকারের মধ্যে হতেই পারে না। ইংলন্ডের মানুষ যে ঐশ্বর্যকে সভ্যতার অপরিহার্য অঙ্গ বলে জানে তাকে লাভ ও রক্ষা করতে গেলে ভারতবর্ষকে অধীন রূপে পেতেই হবে ? তাকে ত্যাগ করতে হলে আপন অতিভোগী সভ্যতার আদর্শকে খর্ব না করে তার উপায় নেই। যে শক্তিসাধনা তার চরম লক্ষ্য সেই সাধনার উপকরণ রূপে তার পক্ষে দাস-জাতির প্রয়োজন আছে। আজ তাই সমস্ত ব্রিটিশ জাতি সমস্ত ভারতবর্ষের পরাশিতরূপে বাস করছে। এই কারণেই যুরোপের বড়ো বড়ো জাতি এশিয়া-আফ্রিকাকে ভাগাভাগি করে নেবার জন্যে ব্যস্ত ; নইলে তাদের ভোগবহুল সভ্যতাকে আধ-পেটা থাকতে হয়। এই কারণে বৃহদংশিকের উপর নূনাংশকের পারাশিত তাদের নিজের দেশেও বড়ো হয়ে উঠেছে। অতিভোগের সম্বল সর্বসাধারণের মধ্যে সমতুল্য হতেই পারে না, অল্পলোকের সঞ্চয়কে প্রভূত করতে গেলে বহুলোককে বঞ্চিত হতেই হয়। পাশ্চাত্য দেশে এই সমস্যাই আজ সবচেয়ে উগ্রভাগে উদ্যত। সেখানে কমিক ও ধ্বনিকে যে বিরোধ তার মূলে এই অপরিমিত ভোগের জন্য সংহত লোভ। তাতে করেই। ধনিক ও ধনের বাহনে একান্ত বিভাগ, যেমন বিভাগ বিদেশীয় প্রভুজাতির সঙ্গে দাস-জাতির। তারা অত্যন্ত পৃথক। এই , অত্যন্ত পার্থক্য মানবধর্মবিরুদ্ধ ; মানবের পক্ষে মানবিক ঐক্য যেখানেই পীড়িত সেইখানেই বিনাশের শক্তি প্ৰকাশ্য বা গোপন ভাবে বড়ো হয়ে ওঠে । এইজন্যেই মানবসমাজের প্রভু প্ৰত্যক্ষ ভাবে মারে দাসকে, কিন্তু দাস প্রভুকে অপ্রত্যক্ষ ভাবে তার চেয়ে বড়ো মার মারে ; সে ধর্মবুদ্ধিকে বিনাশ করতে থাকে। মানবের পক্ষে সেইটে গোড়া ঘেঁষে সাংঘাতিক ; কেননা অন্নের অভাবে মরে পশু, ধর্মের অভাবে মরে মানুষ { ঈসপের গল্প আছে, সতর্ক হরিণ যে দিকে কানা ছিল সেই দিকেই সে বাণ খেয়ে মরেছে। বর্তমান মানবসভ্যতায় কানা দিক হচ্ছে তার বৈষয়িক দিক । আজকের দিনে দেখি, জ্ঞান-অর্জনের দিকে য়ুরোপের একটা বৃহৎ ও বিচিত্র সহযোগিতা, কিন্তু বিষয়-অর্জনের দিকে তার দারুণ প্রতিযোগিতা। তার ফলে বর্তমান যুগে জ্ঞানের আলোক যুরোপের এক প্রদীপে সহস্রশিখায় জ্বলে উঠে আধুনিক কালকে অত্যুজ্জ্বল করে তুলেছে। জ্ঞানের প্রভাবে যুরোপ পৃথিবীর অন্যান্য সকল মহাদেশের উপর মাথা তুলেছে। মানুষের জ্ঞানের যজ্ঞে আজ যুরোপীয় জাতিই হােতা, সেই পুরোহিত ; তার হােমানলে সে বহু দিক থেকে বহু ইন্ধন একত্র করছে, এ যেন কখনো নিববে না, এমন এর আয়োজন এবং • অভাব। মানুষের ইতিহাসে জ্ঞানের এমন বহুব্যাপক সমবায়নীতি আর কখনো দেখা যায় নি । ইতিপূর্বে প্রত্যেক দেশ স্বতন্ত্ৰ ভাবে নিজের বিদ্যা নিজে উদভাবন করেছে। গ্ৰীসের বিদ্যা প্রধানত গ্ৰীসের, রোমের বিদ্যা রোমের, ভারতের চীনেরও তাই। সৌভাগ্যক্রমে যুরোপীয় মহাদেশের দেশপ্রদেশগুলি ঘনসন্নিবিষ্ট, তাদের প্রাকৃতিক বেড়াগুলি দুর্লঙ্ঘ্য নয়- অতিবিত্তীর্ণ মরুভূমি বা উক্তৃঙ্গ গিরিমালা দ্বারা তারা একান্ত পৃথককৃত হয় নি। তার পরে এক সময়ে এক ধর্ম যুরোপের সকল দেশকেই অধিকার করেছিল ; শুধু তাই নয়, এই ধর্মের কেন্দ্ৰস্থল অনেক কাল পর্যন্ত ছিল এক রোমে । এক লাটিন ভাষা অবলম্বন করে অনেক শতাব্দী ধরে যুরোপের সকল দেশ বিদ্যালোচনা করেছে। এই ধর্মের ঐক্য থেকেই সমস্ত মহাদেশ জুড়ে বিদ্যার ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ধর্মের বিশেষ প্রকৃতিও ঐক্যমূলক, এক খৃস্টর প্রেমই তার কেন্দ্র এবং সর্বমানবের সেবাই সেই ধর্মের অনুশাসন। অবশেষে লাটিনের ধাত্রীশালা থেকে বেরিয়ে এসে যুরোপের প্রত্যেক দেশ আপন ভাষাতেই বিদ্যার চর্চা করতে আরম্ভ করলে। কিন্তু সমবায়নীতি অনুসারে নানা দেশের সেই বিদ্যা এক প্রণালীতে সঞ্চারিত ও একই ভাণ্ডারে সঞ্চিত হতে আরম্ভ করলে। এর থেকেই জন্মালো পাশ্চাত্য সভ্যতা, সমবায়মূলক জ্ঞানের সভ্যতা- বিদ্যার ক্ষেত্রে বহু প্রত্যঙ্গের সংযোগে একাঙ্গীকৃত সভ্যতা। আমরা প্রাচ্য সভ্যতা কথাটা ব্যবহার করে থাকি, কিন্তু এ সভ্যতা এশিয়ার ভিন্ন ভিন্ন দেশের চিত্তের সমবায় মূলক নয় ; এর যে পরিচয় সে নেতিবাচক, অর্থাৎ এ সভ্যতা যুরোপীয় নয় এইমাত্র। নতুবা আরবের সঙ্গে চীনের বিদ্যা শুধু মেলে নি যে তা নয়, অনেক বিষয় তারা পরস্পরের বিরুদ্ধ। সভ্যতার বাহ্যিক রূপ ও আন্তরিক প্রকৃতি তুলনা করে দেখলে ভারতীয় হিন্দুর সঙ্গে পশ্চিম-এশিয়া-বাসী সেমেটিকের অত্যন্ত বৈষম্য। এই উভয়ের চিত্তের ঐশ্বৰ্য পৃথক ভাণ্ডারে জমা হয়েছে। এই জ্ঞান-সমবায়ের অভাবে এশিয়ার সভ্যতা