পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যিশুচরিত বাউল সম্প্রদায়ের একজন লোককে একবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “তোমরা সকলের ঘরে খাও না ? সে কহিল, “না।” কারণ জিজ্ঞাসা করাতে সে কহিল, “যাহারা আমাদের স্বীকার করে না। আমরা তাহাদের ঘরে খাই না।’ আমি কহিলাম, ‘তারা স্বীকার না করে নাই করিল, তোমরা স্বীকার করিবে না । কেন । সে লোকটি কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সরল ভাবে কহিল, ‘তা বটে, ঐ জায়গাটাতে আমাদের একটু প্যাচ আছে।” - আমাদের সমাজে যে ভেদবুদ্ধি আছে তাহারই দ্বারা চালিত হইয়া কোথায় আমরা অন্ন গ্ৰহণ করিব আর কোথায় করিব না। তাঁহারই কৃত্রিম গণ্ডিরেখা-দ্বারা আমরা সমস্ত পৃথিবীকে চিহ্নিত করিয়া রাখিয়াছি। এমনকি, যে-সকল মহাপুরুষ সমস্ত পৃথিবীর সামগ্ৰী, তাহাদিগকেও এইরূপ কোনাে-না-কোনাে একটা নিষিদ্ধ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করিয়া পর করিয়া রাখিয়াছি। তঁহাদের ঘরে অন্ন গ্রহণ করিব না বলিয়া স্থির করিয়া বসিয়া আছি। সমস্ত জগৎকে অন্ন বিতরণের ভার দিয়া বিধাতা র্যাহাদিগকে পাঠাইয়াছেন আমরা স্পর্ধার সঙ্গে তাহাদিগকেও জাতে ঠেলিয়াছি। মহাত্মা যিশুর প্রতি আমরা অনেকদিন এইরূপ একটা বিদ্বেষভাব পোষণ করিয়াছি । আমরা তীহাকে হৃদয়ে গ্রহণ করিতে অনিচ্ছুক। কিন্তু এজন্য একলা আমাদিগকেই দায়ী করা চলে না। আমাদের খৃষ্টর পরিচয় প্রধানত সাধারণ খৃষ্টান মিশনারিদের নিকট হইতে । খৃষ্টকে তাহারা খৃষ্টানি-দ্বারা আচ্ছন্ন করিয়া আমাদের কাছে ধরিয়াছেন। এ পর্যন্ত বিশেষভাবে তীহাদের ধর্মমতের দ্বারা আমাদের ধর্মসংস্কারকে তাহারা পরাভূত শুক্ল চেষ্টা করছেন । সুতরাং আত্মরক্ষার চেষ্টায় আমরা লড়াই করিবার জন্যই প্রস্তুত হইয়া লড়াইয়ের অবস্থায় মানুষ বিচার করে না। সেই মত্ততার উত্তেজনায় আমরা খৃষ্টানকে আঘাত করিতে গিয়া খৃষ্টকেও আঘাত করিয়াছি। কিন্তু যাহারা জগতের মহাপুরুষ, শত্ৰু কল্পনা করিয়া তঁহাদিগকে আঘাত করা আত্মঘাতেরই নামান্তর । বস্তুত শত্রুর প্রতি রাগ করিয়া আমাদেরই দেশের উচ্চ আদর্শকে খর্ব করিয়াছি- আপনাকে ক্ষুদ্র করিয়া দিয়াছি। সকলেই জানেন ইংরাজি শিক্ষার প্রথমাবস্থায় আমাদের সমাজে একটা সংকটের দিন উপস্থিত হইয়াছিল। তখন সমস্ত সমাজ টলমল, শিক্ষিতের মন আন্দোলিত। ভারতবর্ষে পূজাৰ্চনা সমস্তই বয়ঃপ্রাপ্ত শিশুর খেলমাত্র- এ দেশে ধর্মের কোনো উচ্চ আদর্শ, ঈশ্বরের কোনো সত্য উপলব্ধি কোনো কালে ছিল না- এই বিশ্বাসে তখন আমরা নিজেদের সম্বন্ধে লজ্জা অনুভব করিতে আরম্ভ করিয়াছিলাম। এইরূপে হিন্দুসমাজের কূল যখন ভাঙিতেছিল, শিক্ষিতদের মন যখন ভিতরে ভিতরে আক্রমণের সম্মুখে আমাদিগকে দুর্বল করিয়া তুলিতেছিল, সেই সময়ে খৃষ্টান মিশনরি আমাদের সমাজে যে বিভীষিকা আনয়ন করিয়ছিল তাহার প্রভাব এখনো আমাদের হৃদয় হইতে সম্পূর্ণ দূর হয় নাই। কিন্তু সেই সংকট আজ আমাদের কাটিয়া গিয়াছে। সেই ঘোরতর দুর্যোগের সময় রামমোহন রায় বাহিরের আবর্জনা ভেদ করিয়া আমাদের দেশের নিত্য সম্পদ সংশয়াকুল স্বদেশবাসীর নিকট